সোমনাথবাবু ভদ্রতা করে বললেন, “আপনি কোথায় থাকেন?”
“বেশ একটু দূরে। অনেকটা পথ।”
“গাড়িটা কি মেরামত হয়ে গেছে? নইলে আমি আমার ড্রাইভারকে বলে দেখতে পারি, সে গাড়ির কাজ খানিকটা জানে।”
লোকটা গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল, “এ গাড়ি ঠিক আপনাদের গাড়ি নয়। আচ্ছা চলি।”
লোকটা চলে যাওয়ার পর সোমনাথবাবু বাহাদুরকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, “যে লোকটা একটু আগে এসেছিল তাকে তুই চিনিস? ফস করে ঢুকতে দিলি যে বড়?”
বাহাদুর তার ছোটো চোখ যথাসম্ভব বড় করে বলল, “কেউ তো আসেনি বাবু।”
‘আলবাৎ এসেছিল, তুই তাকে সেলামও করেছিস।”
বাহাদুর মাথা নেড়ে বলে, “না, আমি তো কাউকে সেলাম করিনি। শুধু সাতটার সময় আপনি যখন বাড়ি ঢুকলেন তখন আপনাকে সেলাম করেছি।”
সোমনাথবাবু অবাক হয়ে বললেন, “আমি! আমি সকালে আজ বাইরেই যাইনি তা ঢুলুম কখন? ওই বেঁটে বিচ্ছিরি টেকো লোকটাকে তোর আমি বলে ভুল হলো নাকি?”
সোমনাথবাবু তার কুকুরদের ডাকলেন এবং একতরফা খুব শাসন করলেন, “নেমকহারাম, বজ্জাত, তোরা এতকালের ট্রেনিং ভুলে একজন অজ্ঞাতকুলশীলকে বাড়িতে ঢুকতে দিলি! টুঁ শব্দটিও করলি না!”
কুকুররা খুবই অবোধ বিস্ময়ে চেয়ে রইল।
মাসখানেক কেটে গেছে। বেঁটে লোকটার কথা একরকম ভুলেই গেছেন সোমনাথবাবু। সকালবেলায় তিনি বাগানের গাছগাছালির পরিচর্যা করছিলেন। তার সাতটা কুকুর দৌড়ঝাঁপ করছে বাগানে। ফটকে সদাসতর্ক বাহাদুর পাহারা দিচ্ছে। শীতের রোদ সবে তেজি হয়ে উঠতে লেগেছে।
একটা মোলায়েম গলাখাঁকারি শুনে সোমনাথবাবু ফিরে তাকিয়ে অবাক। সেই লোকটা। মুখে একটু ক্যাবলা হাসি।
সোমনাথবাবু লোকটাকে দেখে বিশেষ সন্তুষ্ট হলেন না। কারণ, আজও দেখছেন বাহাদুর লোকটাকে আটকায়নি এবং কুকুরেরাও নির্বিকার। সোমনাথবাবু নিরুত্তাপ গলায় বললেন, “এই যে! কী খবর?”
“আজ্ঞে খবর শুভ। আজও আমার বড্ড খিদে পেয়েছে।”
“তার মানে আজও কি আপনার গাড়ি খারাপ হয়েছে?”
‘হ্যাঁ। দূরের পাল্লায় চলাচল করতে হয়, গাড়ির আর দোষ কী?”
“তা বলে আমার বাড়িটাকে হোটেলখানা বানানো কি উচিত হচ্ছে? আর আপনার গতিবিধিও রীতিমতো সন্দেহজনক। আপনি এলে দারোয়ান ভুল দেখে, কুকুরেরাও ভুল বোঝে। ব্যাপারটা আমার সুবিধে ঠেকছে না।”
লোকটা যেন বিশেষ লজ্জিত হয়ে বলে, “আমাকে দেখতে হুবহু আপনার মতোই কিনা, ভুল হওয়া স্বাভাবিক।”
সোমনাথবাবু এ কথা শুনে একেবারে বুরবক, “তার মানে? আমাকে দেখতে আপনার মতো! আমি কি বেঁটে? আমার মাথায় কি টাক আছে?”
লোকটা ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলে, “না না, তা নয়। আপনি আমার চেয়ে আট ইঞ্চি লম্বা, আপনার হাইট পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি। আপনার মাথায় দু লক্ষ সাতাশ হাজার তিনশ পঁচিশটা চুল আছে। আপনি দেখতেও অনেক সুদর্শন। তবু কোথায় যেন হুবহু মিলও আছে।”
উত্তেজিত সোমনাথবাবু বেশ ধমকের গলায় বললেন, “কোথায় মিল মশাই? কিসের মিল?”
লোকটা একটা রুমালে টাকটা মুছে নিয়ে বলল, “সেটা ভেবে দেখতে হবে। এখন হাতে সময় নেই। আমার বড় খিদে পেয়েছে।”
সোমনাথবাবু অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, “খিদে পেয়েছে তো হোটেলে গেলেই হয়।”
লোকটা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, “আমার কাছে পয়সা নেই যে!”
“পয়সা নেই!” এদিকে তো দিব্যি গাড়ি হাঁকিয়ে যাতায়াত করেন। তাহলে পয়সা নেই কেন?”
লোকটা কাঁচুমাচু মুখে পকেটে হাত দিয়ে একটা কাঠি বের করে বলল, “এ জিনিস এখানে চলবে?”
“তার মানে?”
“আমাদের দেশে এগুলোই হচ্ছে বিনিময় মুদ্রা। এই যে কাঠির মতো জিনিসটা দেখছেন এটার দাম এখানকার দেড়শ টাকার কাছাকাছি। কিন্তু কে দাম দেবে বলুন।”
সোমনাথবাবু ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “কাঠি! কাঠি আবার কোথাকার বিনিময় মুদ্রা হলো! এসব তো হেঁয়ালি ঠেকছে।”
লোকটা একটু কাতর মুখে বলল, “সব কথারই জবাব দেবো। আগে কিছু খেতে দিন। বড্ড খিদে।”
সোমনাথবাবু রুষ্ট হলেন বটে, কিন্তু শেষ অবধি লোকটাকে খাওয়ালেনও। লোকটা যখন গোগ্রাসে পরোটা খাচ্ছে তখন সোমনাথবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা আপনার নাম বা ঠিকানা কিছুই তো বলেননি, কী নাম আপনার?”
লোকটা কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “নামটা শুনবেন! একটু অদ্ভুত নাম কিনা, আমার নাম খ।”
সোমনাথবাবু চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘শুধু খ! এরকম নাম হয় নাকি?”
“আমাদের ওখানে হয়।”
“আর পদবি?”
“খ মানেই নাম আর পদবি। খ হলো নাম আর অ হলো পদবি। দুয়ে মিলেই ওই খ।”
“ও বাবা! এ তো খুব অদ্ভুত ব্যাপার।”
“আমাদের সবই ওরকম।”
“তা আপনার বাড়ি কোথায়?”
“একটু দূরে। সাড়ে তিনশো আল হবে।”
“আল! আল আবার কী জিনিস?”
“ওটা হলো দূরত্বের মাপ।”
“এরকম মাপের নাম জন্মে শুনিনি মশাই। তা আল মানে কত? মাইল খানেক হবে নাকি?”
লোকটা হাসল, “একটু বেশি। হাতে সময় থাকলে চলুন না, আমার গাড়িটায় চড়ে আলের মাপটা দেখে আসবেন।”
“না না, থাক।”
লোকটা অভিমানী মুখে বলে, “আপনি বোধহয় আমাকে ঠিক বিশ্বাস করছেন না! আমি কিন্তু ভাল লোক। মাঝে মাঝে খিদে পায় বলে হামলা করি বটে, কিন্তু আমার কোনও বদ মতলব নেই।”
সোমনাথবাবু লজ্জা পেয়ে বললেন, “আরে না না। ঠিক আছে, বলছেন যখন যাচ্ছি। তবে এ সময়ে আমি একটু ব্যস্ত আছি কিনা, বেশি সময় দিতে পারব না।”
“তাই হবে, চলুন, গাড়িটা পিছনের মাঠে রেখেছি।”