কিন্তু আজ সকালে সোমনাথবাবুকে খুবই অবাক হয়ে যেতে হলো। ঘড়িতে মোটে সাতটা বাজে। শীতকাল। সবে রোদের লালচে আভা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ঠিক এই সময়ে বাগানের ফটক খুলে বেঁটেমত টাকমাথার একটা লোক ঢুকল। দারোয়ান বা কুকুরদের দিকে ভ্রূক্ষেপও করল না। পাথরকুঁচি ছড়ানো পথটা দিয়ে সোজা বারান্দার দিকে হেঁটে আসতে লাগল। আশ্চর্যের বিষয়, দিনের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেয়েও বাহাদুর তাকে বাধা দিল না এবং কুকুরেরাও যেমন খেলছিল তেমনিই ছোটাছুটি করে খেলতে লাগল। একটা ঘেউ পর্যন্ত করল না।
সোমনাথবাবু অবাক হয়ে চেয়েছিলেন। আশ্চর্য! খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার!
লোকটার চেহারা ভদ্রলোকের মতোই, মুখখানায় একটা ভালমানুষীও আছে, তবে পোশাকটা একটু কেমন কেমন, মিস্তিরি বা ফিটাররা যেমন তেলকালি লাগার ভয়ে ওভারল পরে, অনেকটা সেরকমই একটা জিনিস লোকটার পরনে। পায়ে এই শীতকালেও গামবুট ধরনের জুতো। কারও মাথায় এমন নিখুঁত টাকও সোমনাথবাবু কখনও দেখেননি। লোকটার মাথায় একগাছি চুলও নেই।
বারান্দায় উঠে আসতেই সোমনাথবাবু অত্যন্ত কঠোর গলায় বলে উঠলেন, “কী চাই? কার হুকুমে এ বাড়িতে ঢুকেছেন?”
লোকটা জবাবে পাল্টা একটা প্রশ্ন করল, “আপনি কি সকালের জলখাবার সমাধা করেছেন?”
সোমনাথবাবু খুব অবাক হয়ে বললেন, “না তো–ইয়ে–মানে আপনি কে বলুন তো?”
লোকটা মুখোমুখি একটা বেতের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে বলল, “আমার খুবই খিদে পেয়েছে। হাতে বিশেষ সময়ও নেই।”
লোকটার বাঁ কবজিতে একটা অদ্ভুত দর্শন ঘড়ি। বেশ বড় এবং ডায়ালে বেশ জটিল সব ছোটো ছোটো ডায়াল ও কাঁটা রয়েছে।
সোমনাথবাবু একটু গলা খাঁকারি দিয়ে রাগটাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে বললেন, “দেখুন, আপনি একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন। অচেনা বাড়িতে ফস করে ঢুকে পড়া মোটেই ভদ্রতাসম্মত নয়। তার ওপর বিনা নিমন্ত্রণে খেতে চাইছেন–এটাই বা কেমন কথা?”।
লোক্টা অবাক হয়ে বলে, “আপনার খিদে পেলে আপনি কী করেন?”
“আমি! আমি খিদে পেলে খাই, কিন্তু সেটা আমার নিজের বাড়িতে।”
“আমিও খিদে পেলে খাই।” এই বলে লোকটা মিটিমিটি হাসতে লাগল।
সোমনাথবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “আপনি নিজের বাড়িতে গিয়ে খান না।”
লোকটা হাসি হাসি মুখ করেই বললেন, “আমার নিজের বাড়ি একটু দূরে। আমার গাড়িটা খারাপ হয়ে যাওয়ায় এখানে একটু আটকে পড়েছি।”
সোমনাথবাবু বিরক্তির ভাবটা চেপে রেখে বললেন, “আপনি আমার দারোয়ানকে ফাঁকি দিয়ে কুকুরগুলোর চোখ এড়িয়ে কী করে ঢুকলেন সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। এ বাড়িতে কোনও লোক কখনও খবর দিয়ে ঢুকতে পারে না।”
লোকটা ভালোমানুষের মতো মুখ করে বলে, “সে কথা ঠিকই, আপনার দারোয়ান বা কুকুরেরা কেউই খারাপ নয়। ওদের ওপর রাগ করবেন না। আচ্ছা, আপনার কি সকালের দিকে খিদে পায় না? খেতে খেতে বরং দু-চারটে কথা বলা যেত।”
এই বলে লোকটা এমন ছেলেমানুষের মতো সোমনাথবাবুর মুখের দিকে চেয়ে রইল যে সোমনাথবাবু হেসে ফেললেন, তারপর বললেন, “আপনি একটু অদ্ভুত আছেন মশাই! আচ্ছা, ঠিক আছে, জলখাবার খাওয়াচ্ছি একটু বসুন।”
সোমনাথবাবু উঠে ভিতর বাড়িতে এসে রান্নার ঠাকুরকে জলখাবার দিতে বলে বারান্দায় ফিরে এসে স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন, তাঁর ভয়ংকর সাত সাতটা কুকুর বারান্দায় উঠে এসে বেঁটে লোকটার চারধারে একেবারে ভেড়ার মতো শান্ত হয়ে বসে মুখের দিকে চেয়ে আছে। আর লোকটা খুব নিম্নস্বরে তাদের কিছু বলছে।
সোমনাথবাবুকে দেখে লোকটা যেন একটু লজ্জা পেয়েই বলল, “এই একটু এদের সঙ্গে কথা বললুম আর কি। ওই যে জিমি কুকুরটা, ওর কিন্তু মাঝে মাঝে পেটে ব্যথা হয়, একটু চিকিৎসা করাবেন। আর টমি বলে ওই যে অ্যালসেশিয়ানটা আছে, ও কিন্তু একটু অপ্রকৃতিস্থ, সাবধান থাকবেন।”
সোমনাথবাবু এত বিস্মিত যে মুখে প্রথমটায় কথা সরল না। বিস্ময় কাটিয়ে উঠে যখন কথা বলতে পারলেন তখন গলায় ভাল করে স্বর ফুটছে না, “আপনি ওদের কথা বুঝতে পারেন? ভাবই বা হলো কী। করে?”
লোকটাও যেন একটু অবাক হয়ে বলে, “আপনি কুকুর পোষেন অথচ তাদের ভাষা বা মনের ভাব বোঝেন না এটাই বা কেমন কথা? ওরা তো আপনার কথা দিব্যি বোঝে। দু পায়ে দাঁড়াতে বললে দাঁড়ায়, পাশের ঘর থেকে খবরের কাগজ নিয়ে আসতে বললে নিয়ে আসে। তাই না? ওরা যা পারে আপনি তা পারেন না কেন?”
সোমনাথবাবুকে স্বীকার করতে হলো যে কথাটায় যুক্তি আছে। তারপর বললেন, “কিন্তু ভাব করলেন কী করে?”
“ওরা বন্ধু আর শত্রু চিনতে পারে।” সোমনাথবাবু আমতা আমতা করে বললেন, “কিন্তু বাহাদুর! বাহাদুর তো আমার মতোই মানুষ। তার ওপর ভীষণ সাবধানী লোক। তাকে হাত করা তো সোজা নয়।”
লোকটা মিটিমিটি হেসে বলে, “আমি যখন ঢুকছিলাম তখন বাহাদুর হাসিমুখে আমাকে একটা সেলামও করেছিল। শুধু আপনিই কেমন যেন আমাকে বন্ধু বলে ভাবতে পারছেন না।”
সোমনাথবাবু একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, “মানে–ইয়ে–যাকগে, আমার এখন আর কোনও বিরূপ ভাব নেই।”
‘আমার কিন্তু খুবই খিদে পেয়েছে।”
শশব্যস্ত সোমনাথবাবু বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ব্যবস্থা হয়েছে। আসুন।”
লোকটার সত্যিই খুব খিদে পেয়েছিল, গোগ্রাসে পরোটা আর আলুর চচ্চড়ি খেল, তারপর গোটা পাঁচেক রসগোল্লাও। চা বা কফি খেল না। খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ে ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলল, “আর সময় নেই, ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই রওনা হতে হবে।”