মল্লিনাথ তা বলে হাল ছাড়ল না। গর্তের কাছে গিয়ে প্রথমে অনেক কাকুতি মিনতি করল। কাজ হলো না দেখে একটা লোহার শাবল এনে গর্ত বড় করতে বসল। মল্লিনাথের গায়ে জোর নেই, মাদুলির ভারেই সে জর্জরিত। কিন্তু বন্ধু হারিয়ে যাওয়ার শোকে তার গায়ে দ্বিগুণ বল এল। তাবিজ কবচ মাদুলির জন্য শাবল চালাতে অসুবিধে হচ্ছিল বলে এক-এক টান মেরে ছিঁড়ে ফেলে দিল সেগুলো। ভারী শাবলটা প্রাণপণে চালাতে লাগল।
হাত দেড়েক গর্ত খোঁড়ার পরই সে একটা ভুসভুসে ইটের গাঁথনি পেল। শাবলের দুটো চাড়ে উপড়ে ফেলল ইট। দেখল ঘরের নীচে আর একটা গুপ্ত কুঠুরি রয়েছে। ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। গর্তে মুখ দিয়ে মল্লিনাথ ডাকে, “এসো ভাই সবুজ লেজ, আমার যে তুমি ছাড়া বন্ধু নেই। আমি যে ইস্কুলে যাই না, কারো সঙ্গে ভাব করতে পারি না, সবাই যে আমাকে খ্যাপায়।”
কিন্তু সবুজ লেজ আর বেরোয় না। মল্লিনাথ একটা টর্চ নিয়ে এসে গর্তের মধ্যে লাফিয়ে নেমে পড়ল।
চোর-কুঠুরিতে টর্চের আলো ফেলে সে দেখল, চারদিকে তিন-চারটে লোহা আর কাঠের সিন্দুক। অনেক রুপোর আর সোনার বাসন রয়েছে দেয়াল আলমারিতে। কিন্তু সেসব গ্রাহ্যও করল না মল্লিনাথ। আঁতি পাঁতি করে খুঁজতে লাগল তার বন্ধুকে। সিন্দুক শাবলের চাড়ে খুলে ফেলে দেখল, রাশি রাশি সোনা আর রুপোর মোহর আর টাকা, হিরে জহরত, গয়না, সোনার বাঁট। সব হাঁটকে-মাটকে সে সবুজ লেজকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোথাও পায় না। পায় না তো পায় না।
ক্লান্ত হয়ে সে একসময় শাবল আর টর্চ ফেলে দিয়ে হাঁটুতে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল অনেকক্ষণ। তারপর খুব রেগে গিয়ে বলল, “ঠিক আছে, আমিও মজা দেখাচ্ছি। আজ থেকেই আমি অন্য সব ছেলের সঙ্গে মিশব। তাদের সঙ্গে ভাব করব, খেলব। তখন দেখো তোমার হিংসে হয় কি না।”
এই বলে মল্লিনাথ কুঠুরির বাইরে বেরিয়ে আসে। গর্তের মুখ ভাল করে ইট আর মাটি দিয়ে বুজিয়ে দেয়। তার চোখে জল, মুখ থমথম করছে অভিমানে।
দুম দুম করে পা ফেলে হেঁটে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। পাড়ার ছেলেরা গলির মুখ আটকে ইট সাজিয়ে রবারের বলে ক্রিকেট খেলছিল। মল্লিনাথ গিয়ে বল কেড়ে নিল একটা ছেলের হাত থেকে। তারপর দৌড়ে গিয়ে এমন জোরে বল করল যে, ইটের স্ট্যাম্প পর্যন্ত তিন হাত ছিটকে গিয়ে ভেঙে পড়ল। ছেলেরা মল্লিনাথের এলেম দেখে খ্যাপাতে ভুলে গেল। ওস্তাদ ওস্তাদ’ বলে চেঁচাল কয়েকটা ছেলে। মল্লিনাথ পরের বলটা করল আরো ভয়ংকর। বলটাই ফেটে গেল ফটাস করে। যার বল, সে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল।
মল্লিনাথ কঁদুনে ছেলেটার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, “কুছ পরোয়া নেই। আমার বল ব্যাট অনেক আছে। আনছি।” বলে দৌড়ে গিয়ে মল্লিনাথ ব্যাট বল আনে। খেলা আবার জমে ওঠে।
মল্লিনাথ ব্যাটও করল অসাধারণ। রাগে গা রি-রি করছে। তাই এত জোরে ব্যাট চালাল যে, মার খেয়ে তিনতলা চারতলা পাঁচতলা বাড়ির ছাদ ডিঙিয়ে বল গিয়ে ওভার বাউন্ডারি হতে লাগল। তার খেলা দেখে সবাই থ।
অনেকক্ষণ খেলে ঘেমে চুমে মল্লিনাথ যখন বাসায় ফিরল, তখন তার রাগ অনেকটা কমেছে, মুখে হাসি ফুটেছে, চোখে মড়ার দৃষ্টি খুব জ্যান্ত হয়ে উঠেছে। সেই দৃশ্য দেখে তার মা আর ঠাকুমা ভয় খেয়ে কেঁদে খুন। “ওগো, কে আমাদের বাছাকে ওষুধ করেছে?”
শুনে মিটিমিটি হাসল মল্লিনাথ। ছাদে গিয়ে সে অনেকক্ষণ ঘুড়ি ওড়াল, বন্দুক টিপ করে তিনটে কঁকড়াবিছে ঘায়েল করল, বনবন করে লার্টু ঘোরাল। বিকেলে পাড়ার কাছে মাঠে গিয়ে ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলে তিন-তিনটে গোলও দিয়ে দিল মল্লিনাথ। সন্ধ্যেবেলা বদ্যিনাথ বাড়ি ফিরলে সে গিয়ে গম্ভীর মুখে বলল, “বাবা, আমাকে ইস্কুলে ভর্তি করে দাও! আমার অনেক বন্ধু চাই।”
শুনে বদ্যিনাথের ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। মল্লি ইস্কুলে যাবে? যেতে আসতেই হাঁফ ধরে যাবে ছেলের!
ওদিকে মল্লিনাথের কাণ্ড দেখে মা আর ঠাকুমা শোবার ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে চেঁচাচ্ছেন আর কাঁদছেন। তাদের ধারণা মল্লি পাগল হয়ে গেছে, এবার হয়তো কামড়ে দেবে। বাড়ির চাকর তান্ত্রিককে ডাকতে গেছে।
বদ্যিনাথও মূৰ্ছাই যাচ্ছিল। মল্লিনাথই তাকে জল-টল দিয়ে চাঙ্গা করল। বলল, “সবুজ লেজটা আমার সঙ্গে খুব বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ওকে আমি মজা দেখাব।”
বদ্যিনাথ হাঁ করে চেয়ে থাকে। কিছু বুঝতে পারে না।
তখন মল্লিনাথ ঘটনাটা খুলে বলে তার বাবাকে নিয়ে গিয়ে গর্ত দেখায়। মাটি ফের খুঁড়ে দুজনে মিলে চোর-কুঠুরিতেও নামে। সব দেখিয়ে মল্লিনাথ বদ্যিনাথকে বলে, “দেখলে তো সবুজ বন্ধুর জন্য খামোখা কত খেটেছি।”
বদ্যিনাথ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “তা বটে।”
মল্লিনাথ একমুঠো হিরে তুলে নিয়ে রাগের চোটে মেঝেয় ছুঁড়ে মেরে বলে, “ওকে মজা দেখাব। অনেক বন্ধু হবে আমার, তখন বুঝবে।”
“ঠিক, ঠিক।” বদ্যিনাথ হাসিমুখে বলে। তারপর বাপ-ব্যাটায় উঠে এসে গর্ত বুজিয়ে ফেলে। পরদিন রাজমিস্ত্রি এনে জায়গাটায় পাকা গাঁথনি দিয়ে দেয়।
এরপর থেকে মল্লিনাথ ক্রমে ক্রমে ভারী জলজ্যান্ত হয়ে ওঠে। যেমন লেখাপড়ায় তেমনি খেলাধূলায়।
চোর কুঠুরির কথা বাপ-ব্যাটা আর মুখেও আনে না।
লোকটা
সোমনাথবাবু সকালবেলায় তাঁর একতলার বারান্দায় বসে কাগজ পড়ছেন। সামনেই মস্ত বাগান, সেখানে খেলা করছে তার সাতটা ভয়ঙ্কর কুকুর। কুকুরদের মধ্যে দুটো বকসার বুলডগ, দুটো ডোবারম্যান, দুটো অ্যালসেশিয়ান, একটা চিশি সড়ালে। এদের দাপটে কেউ বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারে না, তার ওপর গেটে বাহাদুর নামের নেপালি দারোয়ান আছে। তার কোমরে কুকরি, হাতে লাঠি। সদা সতর্ক, সদাতৎপর। সোমনাথবাবু এরকম সুরক্ষিত থাকতেই ভালবাসেন। তাঁর অনেক টাকা, হীরে জহরত সোনাদানা।