“শুধু বাদুড়?” বদ্যিনাথের গিন্নি ঘোমটা খসিয়ে বলেন, “ভাড়ার ঘরের জল-নিকাশি ফুটো দিয়ে একটা লেজ বেরিয়ে যেতে দেখলুম। তা সে কিসের লেজ কে জানে!”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বদ্যিনাথের মা বলেন, “লেজের কথা আর বোলো না। লেজ আমি দিনরাত দেখছি। পরশু রাতে ঘুম ভেঙে মশারির গায়ে একটা কাঁটাওলা লেজ, গতকাল আহ্নিকে বসে ঠাকুরের সিংহাসনের নীচে একটা লোমওলা লেজ, আজ সকালে বাইরের ঘরের চৌকির তলায় একটা লিকলিকে লেজ, আমার নিজের চোখে দেখা। তবে জন্তুগুলোকে ঠাহর করতে পারিনি।”
বদ্যিনাথের ছেলে মল্লিনাথ ছেলেবেলা থেকেই ভারী রোগা-ভোগা। ফ্যাকাশে সরু চেহারা। তার হাতে-গলায় রাজ্যের মাদুলি আর শেকড় বাকড় বাঁধা। সে খেলে না, ছোটে না, দুষ্টুমি করে না। কাঁচকলা আর পেঁপের ঝোল দিয়ে ভাত খায় আর চুপ করে শুয়ে বসে থাকে। রোগে ভোগে বলে তার ঠাকুমা সবাইকে সাফ বলে দিয়েছেন, “বংশের ঐ একটি মাত্র সলতে। লেখাপড়ার ধকল যদি রোগা শরীরে না সয়? নাতি আমার বেঁচে থাক, লেখাপড়ার দরকার নেই।”
তাই মল্লিনাথ ইস্কুলে-পাঠশালেও যায় না। ঘরে বসে খুশিমতো একটু আধটু পড়ে। কথাবার্তা বড় একটা বলে না কারো সঙ্গে। মা বা ঠাকুমার আঁচলের আড়ালে সে বড় হয়। মা-ঠাকুমার কথা শুনে মল্লিনাথও চিচি করে বলল, “লেজ? লেজ তো আমিও দেখি। আমার পড়ার টেবিলের ড্রয়ার থেকে মাঝে মাঝে একটা সবুজ রঙের ভারী সুন্দর লেজ বেরিয়ে ঝুলে থাকে।”
“কী সর্বনাশ!” মা ঠাকুমা একসঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠেন।
বদ্যিনাথ গরিব মানুষ হলেও রোজ ছেলের জন্য খেলনা আনে, খাবার আনে। কিন্তু ছেলের মুখে হাসি ফোটে না, চোখে মড়ার দৃষ্টি জ্যান্ত হয় না। বদ্যিনাথ বল কিনে এনে হাতে দেয়, খেলনা-বন্দুক দেয়, লাটু দেয়, ঘুড়ি লাটাই দেয়, বলে, “কী বাবা, একটু আনন্দ পাচ্ছ? এই দ্যাখো বল, এমনি করে পায়ে নিয়ে ছুটবে। দুম করে লাথি কষাবে, কেমন আনন্দ হবে দেখো।..ঘুড়ি কেমন শো করে আকাশে ওড়ে, না বাবা? দেখেছ তো! তেমনি ওড়াবে ছাদে উঠে, দেখবে বুকখানা ভারী হালকা হবে, ফুর্তি হবে খুব। বন্দুক দিয়ে রোজ টিপ করবে। কত আরশোলা, হঁদুর, চামচিকে চারদিকে দেখছ তো!…টিপ করে করে মারতে মারতে দেখো রক্ত গরম হয়ে উঠবে।…এই দ্যাখো লাটু, কেমন বনবন ঘোরে জানো?”
কিন্তু খেলনা পড়ে থাকে, খাবারও ছোঁয় না মল্লিনাথ। মাদুলির ভারে কুঁজো হয়ে চুপ করে ফ্যাকাশে মুখে বসে থাকে। তার রক্ত গরম হয় না, আনন্দ হয় না, ফুর্তি হয় না। বদ্যিনাথ তার সামনে বল খেলে দেখায়, ঘুড়ি উড়িয়ে দেখায়, লাটু ঘুরিয়ে দেখায়, দেখাতে দেখাতে হাঁফিয়ে ওঠে, নেতিয়ে পড়ে, চিড়বিড়োতে থাকে।
নতুন বাসায় এসে মল্লিনাথ আরো ফ্যাকাশে হয়েছে, আরো রোগা, আরো ন্যাতানো। মা, ঠাকুমা বার-বার তার দিকে তাকিয়ে সারা দিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছেন। ছেলে বাঁচলে হয়! তাই সবুজ লেজের কথা শুনে সবাই আঁতকে উঠল। টেবিল ঝাড়পোঁছ করা তো হলোই, সারা বাড়িতে ছড়ানো হলো কড়া কীটনাশক। এক তান্ত্রিক এসে প্রায় বিশ গ্রাম ওজনের আর-একটা তাবিজ বেঁধে দিয়ে গেল গলায়। মল্লিনাথ আরো একটু কুঁজো হয়ে গেল তার ভারে। তা বলে সবুজ লেজটা কিন্তু তাকে ছাড়ল না। তাবিজ নেওয়ার পরদিন সকালে পড়ার টেবিলে বসে সে ‘গুপ্তধনের খোঁজে’ নামে একটা গল্পের বই পড়ছিল। কনুইতে সুড়সুড়ি লাগায় সে তাকিয়ে দেখল সামান্য ফাঁক হয়ে থাকা ড্রয়ার থেকে সেই কচি কলাপাতা রঙের সুন্দর সবুজ সরু লেজটা বেরিয়ে এসে খুব আদুরে-আদুরে ভাব দেখিয়ে নড়াচড়া করছে। মল্লিনাথ যে ভয় পেল তা নয়। সে চিরকাল কলকাতায় মানুষ। এই প্রায় দশ বছর পর্যন্ত সে একমাত্র চিড়িয়াখানায় ছাড়া আর কোথাও তেমন কোনো জীবজন্তু দেখেনি। লেজটা দেখে তাই তার ভারী অবাক লাগে। ভারী সুন্দর দেখতে, হাত দিতে ইচ্ছে করে। একটু ভয়ে-ভয়ে, সংকোচের সঙ্গে মল্লিনাথ হাত বাড়িয়ে লেজটা একটু ছুঁয়ে দিল। সুট করে সরে গেল লেজটা। পরদিন আবার বেরিয়ে এসে সুড়সুড়ি দিল হাতে। মল্লিনাথ আবার একটু ছুঁল। আর এইভাবেই রোজ সেই সবুজ লেজটার সঙ্গে তার দেখা হতে থাকে। একটু-একটু করে ভাব হতে থাকে। মল্লিনাথের ভারী ভাল লাগে লেজটাকে। একদিন ড্রয়ারটা একটু বেশি ফাঁক করে রাখল সে। লেজটা বেরিয়ে আসতেই উঁকি মেরে দেখল ভিতরে একটা বেশ লম্বা গড়নের সাপের মতো দেখতে প্রাণী কুণ্ডলী পাকিয়ে ঝিমোচ্ছে। পরদিন ড্রয়ারটা আরো ফাঁক করল মল্লিনাথ, সকালবেলা যথারীতি আবার লেজটার সঙ্গে ভাব করতে করতে প্রাণীটিকে দেখল আড়চোখে। ছোটখাটো একটা আমুদে সাপই হবে। অলসভাবে শুয়ে শুয়ে একটা আরশোলা চিবোচ্ছে।
পরদিন মল্লিনাথের ধৈর্য থাকল না। লেজটা বেরোতেই ড্রয়ারটা এক ঝটকায় খুলে ফেলল। লেজটা ধরল মুঠো করে। করুণ স্বরে বলল, “আমার যে আর কোনো বন্ধু নেই।”
সাপটা মল্লিনাথের এই আচরণে ভারী বিরক্ত হয়ে কিলবিলিয়ে পিছলে বেরিয়ে গেল। সড়ত করে ড্রয়ার থেকে নেমে প্রাণপণে ছুটল ভেতর বাড়ির দিকে। মল্লিনাথও লাফিয়ে ওঠে। তার একমাত্র বন্ধু, ভাবের পাত্র পালিয়ে যাচ্ছে। প্রাণপণে মল্লিনাথও তার পিছনে ছোটে।
সবুজ সাপটা ভারী চালাক। সোজা পথে না গিয়ে সে খানিকক্ষণ এ-ঘর সে-ঘর করে পালিয়ে বেড়ায়। আলমারির তলা, খাটেল তলা, জুতোর র্যাকের পিছন, চৌকাঠের আড়ালে ঘুরে অবশেষে উঠোন পেরিয়ে গিয়ে ভাড়ার-ঘরের পিছনে একটা ঘুপসি ছুঁটে-কয়লা রাখার ঘরে গিয়ে ঢুকল। ঘরের কোণে একটা মস্ত গর্তে সেঁধিয়ে গেল সুট করে।