লালটেম অবাক হয়ে চেয়ে আছে তো আছেই। মহারাজা ফোঁস করে একটা শ্বাস ছাড়তে সেই শব্দে লালটেম সচকিত হয়ে মাটিতে নামল লাফ দিয়ে। তাই তো! এই তো সেই রাজবাড়ি মনে হচ্ছে! এক-পা করে দু-পা লালটেম এগোয়।
চারিদিকে শ্যাওলা ধরা পাথর আর ইটের স্তূপ। এই সেই ইট যা রোগা লোকটা তাদের দেখিয়েছিল। সুতরাং এইটাই রাজবাড়ি। লালটেম দেখে, চারধারে নানা রঙের সাপ ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছু সাপ ফণা তুলছে। ফে ফেঁ করে ভয়ঙ্কর শব্দ করছে তারা। কোত্থেকে একটা দুটো তক্ষক ডাকল। ছমছম করে ওঠে এখানকার নির্জনতা। লালটেম ভয় পায় বটে, কিন্তু তবু এগোয়। সাপেরা তার পথ থেকে সরে যায়।
চারদিকে ফিসফাস শব্দ ওঠে। কারা যেন হিঃ হিঃ করে হেসে ওঠে কাছেই। চারদিকে চেয়ে লালটেম কাউকে দেখতে পায় না। আবার এগোয়।
কী করুণ অবস্থা! বিশাল ঘরের আধখানা ভেঙে পড়ে গেছে, বাকি অর্ধেকটায় ধুলো জঞ্জাল আর আগাছা। মাকড়শার জাল এত ধারালো যে, গায়ে লাগলে, চামড়া চিরে যায়। কাঁকড়া বিছেরা বাসা করে আছে যেখানে-সেখানে, একটা ঘরে শেয়ালের বাচ্চারা দলা পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে, একটা জং-ধরা লোহার সিন্দুকের ওপর নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে একটা দাঁতাল শুয়োর।
একটার পর একটা ভাঙা ঘর পার হয় লালটেম। দেখে, অনেকগুলো বন্ধ কুঠুরি। কৌতূহলবশে সে একটা কুঠুরির দরজা ঠেলা দিতেই দরজাটা মড়াত করে ভেঙে পড়ে গেল। লালটেম ভিতরে ঢুকে ভীষণ অবাক হয়ে দেখে, সেখানে অনেক সোনা-রুপোর বাসন পাঁজা করে রাখা।
পাশের কুঠুরিতে ঢুকে লালটেম হাজার হাজার মোহর দেখতে পেল। তার পাশেরটায় গহনা, হীরে, মুক্তো।
কত কী রয়েছে রাজবাড়িতে। দেখে লালটেম অবাক তো অবাক! সবকিছু সে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে, নেড়েচেড়ে দেখে, তারপর আবার যেখানকার জিনিস, সেখানেই রেখে দেয়।
সাতটা কুঠুরির সব-শেষটায় ঢুকে লালটেম দেখে, ধুলোর ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে একটা মানুষের কঙ্কাল! ভীষণ ভয় পেয়ে লালটেম দরজার দিকে পিছু হটে সরে এল।
হঠাৎ কঙ্কালটা নড়ে উঠল। একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ করে কঙ্কালটা বলল, লালটেম, যেও না।
লালটেম ভয় পেয়েও দাঁড়াল।
একবোঝা হাড় নিয়ে খটমট শব্দ করে আস্তে আস্তে কঙ্কালটা উঠে বসে। লালটেম দেখে, কঙ্কালটার পাঁজরের মধ্যে একটা কালো সাপ, মাথার খুলির ভিতর থেকে চোখ আর নাকের ফুটো দিয়ে কাকড়া বিছে বেরিয়ে আসছে, আর সারা গায়ে লাল পিঁপড়ে থিকথিক করছে।
কঙ্কালটা হাত তুলে বলে, আমার দশা দেখেছ?
দেখছি।
ভয় পেও না। এখানে যা কিছু দেখছ, সব সোনাদানা মোহর-গয়না, এ সবই তোমার। নিয়ে যাও।
লালটেম মাথা নেড়ে বলে, নিয়ে কী হবে?
অভাব থাকবে না। খুব বড়লোক হয়ে যাবে। নাও।
বাইরে থেকে গম্ভীর গলায় মহারাজা ডাকল হাংগা।
লালটেম চমকে উঠে বলল, আমার মোযটার জল তেষ্টা পেয়েছে। আমি যাই।
যেও না লালটেম। কিছু নিয়ে যাও।
মহারাজা আবার ডাকে, আঃ-আঃ।
লালটেম ছটফট করে বলে, ‘বেলা বয়ে যাচ্ছে। আমি যাই।
তোমার মোষগুলো বুড়ো হয়েছে লালটেম, একদিন মরবে। তখন বড় দুর্দিন হবে তোমাদের। এইবেলা বড়লোক হয়ে যাও।
মহারাজা বাইরে ভীষণ দাপিয়ে চেঁচায়, গা…গাঁ।
লালটেম একটু হেসে বলে, আমার দিন খারাপ যায় না। বেশ আছি।
কঙ্কালটা রেগে গিয়ে বলে, গাঁ-গঞ্জের হাজারো মানুষ যে রাজবাড়ি খুঁজে খুঁজে হয়রান, সেই রাজবাড়ি পেয়েও তুমি বড়লোক হবে না?
লালটেম একটু ভেবে বলে, না, আমি তো বেশ আছি। চারদিকে কত আনন্দ! কত ফুর্তি!
সাপটা ফোঁস করে কঙ্কালটার পাঁজরায় একটা ছোবল দিল। উঃ করে কঙ্কালটা পাঁজর চেপে ধরে বলল, গত একশো বছর ধরে রোজ ছোবলাচ্ছে রে বাপ।…ইঃ, ওই দেখ, মাথায় ফের কঁকড়াবিছেটা হুল দিলে…কী যন্ত্রণা!..আচ্ছা লালটেম, বলো তো, বোকা লোকগুলো রাজবাড়িটা খুঁজে পায় না কেন? তোমাদের এত কাছে, জঙ্গলের প্রায় ধার ঘেঁষেই তো রয়েছে তবু খুঁজে পায় না কেন? আর যে দু-একজন খুঁজে পায়, সেগুলো একদম তোমার মতোই আহাম্মক। লালটেম, লক্ষ্মী ছেলে, যদি একটা মোহরও দয়া করে নাও, তবে আমি মুক্তি পেয়ে যাই। নেবে?
বাইরে মহারাজা ভীষণ রেগে চেঁচায়, গাঁ-অ্যাঁ।
লালটেম মুখ ঘুরিয়ে নেয়। বলে, নিলেই তো তোমার মতো দশা হবে।
এই বলে লালটেম বেরিয়ে আসে গটগট করে। মহারাজা তাকে দেখে খুশি হয়ে কান লটপট করে, গা শোঁকে, পা দাপিয়ে আনন্দ জানায়।
পরদিন থেকে আবার লালটেম মোষ চরাতে যায়। সাথীদের সঙ্গে খেলে। পাহাড়, জঙ্গল, নদী, মাঠ, চা-বাগান দেখে তার ভারি আনন্দ হয়। রোদ আর আলো, মেঘ আর বৃষ্টি, বাতাস আর দিগন্ত তাকে কত আদর জানায় নানাভাবে। কোনওদিন তার খাবার থাকে। কোনওদিন থাকে না। যেদিন খাবার জোটে না, সেদিন সে মহারাজার পিঠে শুয়ে আকাশ দেখে। তার মনে হয়, সে বেশ আছে। খুব ভালো আছে। তার কোনও দুঃখ নেই।
লেজ
বাসা বদলানোর পর বদ্যিনাথ কিছু ফাঁপরে পড়ে গেল। যে বাড়িতে এল সে-বাড়ি না হোক তো এক দেড়শ’ বছরের পুরোনো। নতুন চুনকাম করা সত্ত্বেও নোনাধরা দেওয়ালের চুনবালি খসে পড়ছে, গত বর্ষার জলের ছাপ এখনো দেয়াল থেকে মোছেনি। তার ওপর বড্ড ঘুপচি আর অন্ধকার, আলো বাতাসের বালাই নেই। চারদিকে সব সময়ে একটা ভেজা-ভেজা ভাব। দেয়াল আর মেঝেয় হরেক রকমের ফাটল। তাতে কাকড়াবিছে তেঁতুলবিছের আস্তানা, এখানে-সেখানে উইয়ের সুড়ঙ্গ পথ, আরশোলা ফরফর করে ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা দিন, লুকনো গর্ত থেকে মাঝে মাঝে একটা ব্যাঙ ডাকে। বদ্যিনাথের নব্বই বছরের বুড়ি-মা দিন রাত ঘ্যানঘ্যান করছেন, “এ কী সোঁদরবন বাবা? কোন্ জীবজন্তুটা নেই এখানে? ঠাকুরঘরে বাদুড় পর্যন্ত ঝুলে আছে।”