নবীনবাবু মিনমিন করে বললেন, একখানা দরখাস্ত নিয়ে ওপর ওয়ালার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তা তিনি বললেন, নিত্যানন্দপুর থেকে আর বদলি করবে না। দেখা যাক।
বাক্স-প্যাটরা গুছিয়ে সপরিবারে এক শীতের সন্ধ্যেবেলা নবীনবাবু নিত্যানন্দপুরে এসে পৌঁছলেন। বেশ ধকল গেল। ট্রেন থেকে নেমে অনেকটা পথ গোরুর গাড়িতে এসে তারপর আবার নদী পেরিয়ে আরও ক্রোশ দুই পেরোলে তবে নিত্যানন্দপুর। গঞ্জমতো জায়গা। তবে নিরিবিলি, কঁকা-ফাঁকা।
রাত্রিটা পোস্টমাস্টারের বাড়িতে কাটিয়ে পরদিন একখানা বাসা ভাড়া করলেন। পাকা বাড়ি, টিনের চাল। উঠোন আছে, কুয়ো আছে।
জায়গাটা ভালোও নয়, মন্দও নয়। ওই একরকম। তবে ভরসা এই যে, আর বারবার ঠাইনাড়া হতে হবে না : ওপরওয়ালা কথা দিয়েছে এখানেই বাকি চাকরির জীবনটা কাটাতে পারবেন নবীনবাবু।
তাঁর স্ত্রী অবশ্য নাক সিঁটকে বললেন, ‘কী অখেদ্দে জায়গা গো! এ যে ধাড়ধাড়া গোবিন্দপুর। অসুখ হলে ডাক্তারবদ্দি পাওয়া যাবে কি না খোঁজ নিয়ে দেখো। দোকানপাটও তো বিশেষ নেই দেখছি। বাজারহাট কোথায় করবে?
নবীনবাবু, বললেন, বাজার এখান থেকে এক ক্রোশ। তাও রোজ বসে না। হপ্তায় দুদিন হাট।
তবেই হয়েছে। এখানে ইস্কুলটা কেমন খোঁজ নিয়েছ?
ইস্কুল একটা আছে মাইলটাক দূরে। কেমন কে জানে।
জায়গাটা এমন বিচ্ছিরি বলেই এখান থেকে তোমাকে আর বদলি করতে ওপরওয়ালা সহজেই রাজি হয়ে গেছে। এখন মরি আমরা এখানে পচে।
নবীনবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, কী আর করা। নিত্যানন্দপুরেই মানিয়ে গুছিয়ে নিতে হবে।
প্রথমদিন বাজার করতে দু-ক্রোশ দূরে গিয়ে বেশ দমেই গেলেন তিনি। জিনিসপত্রের দাম বেশ চড়া। প্রত্যন্ত গাঁ, এখানে জিনিস আনতে ব্যাপারিদের অনেক খরচ হয়। জিনিসপত্র তেমন ভালোও নয়। পাওয়াও যায় না সবকিছু।
বাজারের হাল শুনে গিন্নি চটলেন। বললেন, ‘আবার দরখাস্ত করে অন্য জায়গায় বদলি নাও। এ জায়গায় মানুষে থাকে? মা গো!
নবীনবাবু ফাপড়ে পড়লেন। এখন কী করা যাবে তাই ভাবতে লাগলেন।
একদিন সন্ধ্যেবেলা গিন্নি এসে বললেন, ‘ওগো, খুকি তেলের শিশিটা ভেঙে ফেলেছে। একটি ফোঁটাও তেল নেই আর। রাতে রান্না হবে কী দিয়ে?
তেল পাব কোথায়?
দ্যাখো না একটু খুঁজে পেতে। অনেক গেরস্তবাড়িতে ছোটখাটো জিনিস পাওয়া যায় শুনেছি।
অগত্যা নবীনবাবু বেরোলেন। বেশি লোকের সঙ্গে চেনাজানা হয়নি এখনও। কার বাড়ি যাবেন ভাবছেন। ডান হাতি পথটা ধরে হাঁটছেন। ডান ধারে একটু জঙ্গলমতো আছে। হঠাৎ দেখতে পেলেন, জঙ্গলের একটু ভেতর দিকে একটা আলোই যেন জ্বলছে মনে হল। নবীনবাবু কয়েক পা এগিয়ে ঠাহর করে দেখলেন একখানা ঝাঁপতোলা দোকান বলেই যেন মনে হচ্ছে। নবীনবাবু এগিয়ে গিয়ে দেখলেন, দোকানঘরই বটে। দীনদরিদ্র চেহারা হলেও দোকানই। কালো রোগাপনা কণ্ঠিধারী একজন লোক দোকানে বসে আছে। বিনয়ী মানুষ। নবীনবাবুকে দেখেই টুল থেকে উঠে বলল, আজ্ঞে আসুন।
নবীনবাবু খুশি হলেন। আজকাল বিনয় জিনিসটা দেখাই যায় না। সরষের তেলের খোঁজ করতেই লোকটা বলল, আছে। ভালো ঘানির তেল।
কত দাম? লোকটা হেসে মাথা চুলকে বলল, দাম তো বেশ চড়া। তবে আপনার কাছ থেকে বেশি নেব না। ছটাকা করেই দেবেন।
নবীনবাবু খুবই অবাক হলেন, দু-ক্রোশ দূরের বাজারে তেল দশ টাকা। নবীনবাবু আড়াইশো গ্রাম তেল কিনে আনলেন। গিন্নি তেল পরীক্ষা করে বললেন, বাঃ এ তো দারুণ ভালো তেল দেখছি। কোথায় পেলে গো?
নবীনবাবু বললেন, আরে, কাছেই একটা বেশ দোকানের সন্ধান পেয়েছি। লোকটা বড় ভালো।
লোকটা যে সত্যিই ভালো তার প্রমাণ পাওয়া গেল দুদিন পরেই। ডাল ফুরিয়েছে। সন্ধ্যের পর সেই দোকানে গিয়ে হানা দিতেই বিনয়ী লোকটা প্রায় অর্ধেক দামে ডাল দিল। বলল, আপনাকে অত দাম দিতে হবে না।
নবীনবাবু ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নামই তো জানি না এখনও।
আজ্ঞে, কালাচাঁদ নন্দী। ‘কালো’ বলেই ডাকবেন।
আপনি কি সব জিনিসই রাখেন কালোবাবু?
যে আজ্ঞে । তবে সন্ধ্যের পর আসবেন। দিনমানে আমি দোকান খুলি না। ও সময়ে আমার চাষবাস দেখতে হয়।
দিন দুই পর গিন্নি হঠাৎ বললেন, ও গো, আজ একটু পোলাও খাওয়ার বায়না ধরেছে ছেলেমেয়েরা। ঘি আর গরম মশলা লাগবে। এনে দেবে নাকি একটু?”
কালোর দোকানে ঘি বা গরম মশলা পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছিল নবীনবাবুর। দোনামনা করে গেলেন।
কালাচঁদ বলল, হা-হা, কেন পাবেন না? এক নম্বর ঘি আছে, আর বাছাই গরম মশলা।
দাম?
দাম তো অনেক। তবে আপনাকে অত দিতে হবে না। দশ টাকা করেই দেবেন।
নবীনবাবুর হৃদয় কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল। খানিকক্ষণ কালাচাঁদের সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা বলে তিন ফিরে এলেন। গিন্নি ঘি আর গরম মশলা দেখে খুব খুশি। বললেন, “ওগো, দোকানটা খোকাকে চিনিয়ে দিয়ে তো! দরকার মতো ওকেও পাঠাতে পারব। তা হ্যাঁ গো, দোকানটা কি নতুন খুলেছে? আজ দাস বাড়ির গিন্নি গল্প করতে এসেছিল। কথায় কথায় তাকে কালাচাঁদের দোকানের কথা বললুম। কিন্তু সে তো আকাশ থেকে পড়ল, সাত জন্মে কালাচাঁদবাবুর দোকানের কথা শুনিনি।
হবে হয়তো, নতুনই খুলেছে। আমি খোঁজ নিয়ে বলবখন।
দুদিন পর ফের কালোজিরে আর ময়দা আনতে গিয়ে নবীনবাবু বললেন, তা হা কালাচাঁদবাবু, আপনার দোকানটা কতদিনের পুরোনো?