- বইয়ের নামঃ গোয়েন্দা বরদাচরণ সমগ্র ও অন্যান্য
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ নাথ পাবলিশিং
- বিভাগসমূহঃ সমগ্র
অম্বুজবাবুর ফ্যাসাদ
সকালবেলা অম্বুজ মিত্রের স্ত্রী কাত্যায়নী দেবী ঝি মোক্ষদাকে খুব বকাবকি করছিলেন। স্বামীকে একটু আলু ভেজে ভাত দেবেন, তা সেই আলু ঠিকমতন কুচোনো হয়নি, ডালনায় দেবার হলুদবাটা তেমন মিহি হয়নি, অম্বুজবাবুর গেঞ্জি সকালে কেচে শুকিয়ে রাখার কথা, সেটাও হয়নি, পান সেজে দেবেন, তা সুপুরি ঠিকমতো কাটা হয়নি, আরো কত কী। কাত্যায়নী বললেন, এতকালের ঝি বলে তাড়াতে কষ্ট হয়। মোদা, কিন্তু তবু বলি, তুই অন্য কাজ দেখ।
অম্বুজবাবু তার বাইরের ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। মোক্ষদা গিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছে বলল, “বাবু, গিন্নিমা আমাকে জবাব দিয়েছেন, এবার আমাকে একটা কাজ দেখে দিন।
অম্বুজবাবু মোক্ষদার দিকে ভ্রূ কুঁচকে একটু চেয়ে থেকে বললেন, জবাব দিল কেন?
আমার কাজ ওঁর পছন্দ নয়।
অম্বুজবাবু বিরক্তির সঙ্গে বললেন, ‘দেখি, খোঁপাটা খোল তো।’ মোক্ষদা খোঁপা খুলে ফেলল। অম্বুজবাবু উঠে মোক্ষদার চুলের মধ্যে একটা স্ক্রু ড্রাইভার চালিয়ে ছোট্ট একটা স্ক্র একটু টাইট করে দিলেন। তারপর মোক্ষদার কপালের কঁচপোকার টিপটা খুঁটে তুলে ফেললেন। টিপের নীচে একটা ছ্যাদা, তার মধ্যে একটা শিশি থেকে কয়েক ফোঁটা তরল পদার্থ ঢেলে, ফের টিপটা আটকে দিয়ে বললেন, এবার যা, কাজ কর গে।
মোক্ষদা তবু দাঁড়িয়ে রইল।
অম্বুজবাবু বিরক্তির সঙ্গে বললেন, কী হলো, দাঁড়িয়ে রইলি কেন?
মোক্ষদা মাথা নত করে বলল, আমি আর ঝি-গিরি করব না। আমাকে অন্য কাজ দিন।
অম্বুজবাবু খুব অবাক হয়ে বললেন, ঝি-গিরি করবি না,মানে? তোকে তো ঝি-গিরি করার জন্যই তৈরি করা হয়েছে।
মোক্ষদা ঝংকার দিয়ে বলল, তাতে কি? আমার প্রোগ্রাম ডিস্কটা বদলে দিলেই তো হয়। আমাকে অন্যরকম প্রোগ্রামে ফেলে দেখুন পারি কি না।
অম্বুজবাবু একটু তীক্ষ্ণ চোখে মোক্ষদার দিকে চেয়ে বললেন, ই, খুব লায়েক হয়েছ দেখছি। এঁচোড়ে পক্ক কোথাকার! তা কী করতে চাস?
আমাকে নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট করে দিন।
কাজটা এমন কিছু শক্ত নয় তা অম্বুজবাবু জানেন। মোক্ষদার মগজটা খুলে ফেলে প্রোগ্রাম ডিস্কটা পাল্টে দিলেই হলো। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। নামে মোক্ষদা আর কাজে ঝি হলেও, মোদা আসলে কলের পুতুল। কলের পুতুলদের তৈরি করা হয় কারখানায়। এক এক ধরনের রোবোকে এক এক ধরনের কাজের জন্য প্রোগ্রাম করে দেওয়া হয়। সেই প্রোগ্রাম অনুযায়ী সে চলে। তার নিজের কোনো ইচ্ছা অনিচ্ছা থাকে না বা থাকবার কথাও নয়। তাহলে মোক্ষদার এই যে নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট হওয়ার ইচ্ছে, এটা এল কোথা থেকে?
অম্বুজবাবু চিন্তিতভাবে মোক্ষদার দিকে একটু চেয়ে থেকে বললেন, ঠিক আছে। বেলা তিনটে নাগাদ সেন্ট্রাল রোবো-ল্যাবরেটরিতে যাস।
মোক্ষদা চলে গেলে অম্বুজবাবু উঠলেন, কাজে বেরোতে হবে। কাজ বড় কমও নয় তাঁর। অম্বুজবাবু মস্ত কৃষি বিজ্ঞানী। কৃষিক্ষেত্রে তিনি যে সব অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিয়েছেন তাতে পৃথিবী এবং মহাকাশে বিস্তর ওলোট-পালট ঘটে গেছে। মহাকাশে কড়াইশুটির চাষ করে তিনি প্রথম নোবেল পুরস্কার পান তেইশশো চল্লিশ সালে। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেননি। চাঁদ এবং মঙ্গল গ্রহে তিনি এক আশ্চর্য ছত্রাক তৈরি করেছেন। সেই ছত্রাকের প্রভাবে উঁদে ধীরে ধীরে আবহমণ্ডল এবং জলীয় বাষ্পের সৃষ্টি হচ্ছে। মঙ্গলগ্রহে এখন রীতিমতো গাছপালা জন্মাচ্ছে। আবহমণ্ডলের দূষিত গ্যাস সবই খেয়ে ফেলছে গাছপালা। এ-সব কৃতিত্বের জন্য তাকে আরো তিনবার নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
অম্বুজবাবু তার অটো-চেম্বারে ঢুকলেন। সব ব্যবস্থাই ভারি সুন্দর এবং স্বয়ংক্রিয়। ঢুকতেই দুখানা যান্ত্রিক হাত এসে গাল থেকে দাড়ি মুছে নিল। যন্ত্রের নরম কয়েকখানা হাত তার সর্বাঙ্গে তেল মাখিয়ে দিল। শরীরের সমান তাপমানের জল আপনা থেকেই স্নান করাল তাকে। শরীর শুকনো হলো জলীয়বাষ্পহীন বাতাসে। তারপর নিখুঁত কাছা ও কোঁচায় ধুতি পরালো তাকে যন্ত্র। গায়ে পাঞ্জাবি পরিয়ে বোতাম এঁটে দিল। চুল আঁচড়ে দিল। সব মিলিয়ে সাত মিনিটও লাগল না।
তাঁর বাড়িতে রান্না, ভাত বাড়া এবং খাইয়ে দেওয়ারও যন্ত্র আছে, তবে সেগুলো ব্যবহার করেন না। কাত্যায়নী রাঁধেন, বাড়েন, অম্বুজবাবু নিজের হাতেই খান। খেয়ে, পান মুখে দিয়ে ছেলের ঘরে একবার উঁকি দিলেন তিনি। ছেলে গম্বুজ একটা ভাসন্ত শতরঞ্চিতে উপুড় হয়ে শুয়ে একটি যন্ত্রবালিকার সাথে দাবা খেলছে। গম্বুজের লক্ষণটা ভাল বোঝেন না অম্বুজ। ছেলেটার কোনো মানুষ বন্ধু নেই।ওর সব বন্ধুই হয় যন্ত্রবালকনয় যন্ত্রবালিকা। ‘দুর্গা, দুর্গতিনাশিনী’ বলে কপালে হাত ঠেকিয়ে, একটা পান মুখে দিয়ে, ছাতা বগলে করে অম্বুজবাবু বেরিয়ে পড়লেন।
বেরিয়ে পড়া বলতে যত সোজা, কাজটা তত সোজা নয়। অম্বুজবাবু থাকেন একটা দুশোতলা বাড়ির একশো-সাতাত্তর তলায়। লিফ্ট এবং এসক্যালেটর সবই আছে বটে কিন্তু অম্বুজবাবু এসব ব্যবহার করেন না। তার ফ্ল্যাটে একটা খোলা জানালা আছে তাই দিয়েই তিনি বেরিয়ে পড়েন। শূন্যে পা বাড়িয়ে তিনি ছাতাটা ফট করে খুলে ফেলেন। ছাতাটা আশ্চর্য! অম্বুজবাবুকে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখে। চারদিকে শূন্যে নির্দিষ্ট দূরত্বে ট্র্যাশ-বিন বা ময়লা ফেলার বাক্স ভেসে আছে। তারই একটাতে পানের পিক ফেলে অম্বুজবাবু ছাতার হাতলটা একটু ঘোরালেন। ছাতাটা অমনি তাঁকে নিয়ে দুলকি চালে উড়তে উড়তে আড়াইশো তলা এক পেল্লায় বাড়ির ছাদে এনে ফেলল।