তিনি লিখিয়াছেন, “The wives of the Fijian chiefs consider it a sacred duty to suffer strangulation on the deaths of their husbands. A woman who has been rescued by Williams escaped during the night, and, presenting herself to her own people, insisted on the completion of the sacrifice which she had in a moment of weakness reluctantly consented to forego; and Wilkes tells of another who loaded her rescuer with abuse, and ever afterwards manifested the most deadly harted towards him.” ইহাতে কি বুঝা যায়? বুঝা যায় যে, সহমরণ গৌরবের কাজ হইলে আর্য জাতি ভিন্ন আরো অনেক নীচ জাতি আছে যাহারা তুল্য গৌরবের অধিকারী। আরো একটা কথা এই, পুরুষেরা যাহা ইচ্ছা করে, যাহা ধর্ম বলিয়া প্রচার করে, নারী তাহাই বিশ্বাস করে এবং পুরুষের ইচ্ছাকেই নিজের ইচ্ছা বলিয়া ভুল করে এবং ভুল করিয়া সুখী হয়। হইতে পারে ইহাতে নারীর গৌরব বাড়ে, কিন্তু সে গৌরবে পুরুষের অগৌরব চাপা পড়ে না। যাই প্রশ্ন করা হয়, এত নিষ্ঠুর প্রথা কেন? উত্তর তৎক্ষণাৎ মুখে আসিয়া পড়ে, পরলোকে গিয়া স্বামীর সেবা করিবে! অথচ পরলোক যে কি, তাহা কয়টা পুরুষ জানে? আশ্চর্য, এত অত্যাচার, অবিচার, পৈশাচিক নিষ্ঠুরতা সহ্য করা সত্ত্বেও নারী চিরদিন পুরুষকে স্নেহ করিয়াছে, শ্রদ্ধা করিয়াছে, ভক্তি করিয়াছে এবং বিশ্বাস করিয়াছে! যাহাকে সে পিতা বলে, ভ্রাতা বলে, স্বামী বলে, সে যে এত নীচ, এমন প্রবঞ্চক, এ কথা বোধ করি সে স্বপ্নেও ভাবিতে পারে না। বোধ করি এইখানেই তাহার মূল্য।
বিল্বমঙ্গল একখানি প্রসিদ্ধ নাটক। বহুদিন হইতে, ইহা প্রকাশ্য রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হইতেছে। বাঙালী আপত্তি করে না, কারণ ইহাতে ধর্মের কথা আছে। সহস্র লোকের সম্মুখে দাঁড়াইয়া বণিক লম্বা-চওড়া বক্তৃতা দিয়া নিজের সহধর্মিণীকে লম্পট অতিথির শয্যায় প্রেরণ করে। দর্শক অর্থ ব্যয় করিয়া দেখে এবং খুব তারিফ দিতে থাকে; বণিকের বক্তৃতার সারমর্ম এই, সে প্রতিজ্ঞা করিয়াছে, এ বাড়িতে অতিথি বিমুখ করিবে না। পাছে তাহার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হয়, পাছে অধর্ম হয়, পাছে মৃত্যুর পরে যমদূতে ডাঙস্ মারে, এই তার ভয়। তাহার মনের ভাবটা এই যে, আমার পায়ে তৃণাঙ্কুরও না বিদ্ধ হয়—তোমার যা হয় তা হোক। তা ছাড়া, শাস্ত্রে আছে, সর্বস্ব দিয়াও অতিথি-সৎকার করিবে। অর্থাৎ, ধন-দৌলত, হাতি-ঘোড়া, গরু-বাছুর, যা-কিছু সম্পত্তি আছে সমস্তই। কিন্তু অতিথিটা যখন ও-সব চায় না, তখন তুমিই যাও। আমার কাছে সে তোমাকে চাহিয়াছে—এবং তুমি আমার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে। স্বামীর কাছে পতিব্রতা স্ত্রীর সম্মান এই! অপরিচিত পাপিষ্ঠ অতিথির সেবার তুলনায় স্ত্রীর মূল্য এই! যাহারা বিল্বমঙ্গলের ভক্ত, তাহারা প্রতিবাদ করিয়া বলিবে, অতিথির জন্য হিন্দু প্রাণ দিতে পারে—কর্ণ পুত্রহত্যা করিয়াছিল।
এ-সব কথা আমিও জানি। দাতাকর্ণ মস্ত কাজ করিয়াছিলেন, বণিকও মস্ত কাজ করিয়াছে! কিন্তু কথা সে নয়। প্রাণটা তোমার নিজের, ইচ্ছা হয়, সেটা না হয় দিতে পার, কিন্তু এই যে ধারণা,—স্ত্রী তোমার সম্পত্তি, তুমি স্বামী বলিয়া ইচ্ছা করিলে এবং প্রয়োজন বোধ করিলে তাহার নারী-ধর্মের উপরও অত্যাচার করিতে পার, তাহাকে রাখিতেও পার, মারিতেও পার, বিলাইয়া দিতেও পার, তোমার এই অনধিকার, এই স্বেচ্ছাচার তোমাকে এবং তোমার পুরুষজাতিকে হীন করিয়াছে, এবং তোমার সতী স্ত্রীকে এবং সেই সঙ্গে সমস্ত নারীজাতিকে অপমান করিয়াছে! অতিথিসেবা খুব মস্ত ধর্ম হইতে পারে, কিন্তু সেজন্য যেমন চুরি-ডাকাতি করিতে পার না, এটাও ঠিক তেমনি পার না। ইহুদীরা যখন পশুর মত ছিল, তখন তাহারা সম্পত্তির সঙ্গে স্ত্রীর বখরা করিত। এখন অনেক অসভ্য জাতি বাড়ি-ঘর জমি-জমা গরু-বাছুরের সঙ্গে বাড়ির স্ত্রীগুলিকেও ভায়ে ভায়ে ভাগ করিয়া লয়। স্ত্রী-জাতি সম্বন্ধে বণিকের ধারণাও প্রায় এমনি। আর অতিথি-সৎকার যদি এতবড় ধর্মই হয়, যার কাছে সতী স্ত্রীর সর্বস্ব নষ্ট করিয়া ফেলাও ধর্মপালন, তবে এখনো যাহারা এই ধর্ম রাখিয়া চলে তাহাদের নীচ বলা শোভা পায় না।
আমেরিকার অসভ্য ছিনুক জাতির সম্বন্ধে কাপ্তেন লুইস্ বলিয়াছেন, ইহারা অতিথির শয্যায় বাটীর শ্রেষ্ঠ কন্যাটিকে, না হয়, স্ত্রীকে পাঠাইয়া দেওয়া অতি উচ্চ অঙ্গের ধর্মপালন বলিয়া মনে করে। এশিয়ার চুক্চি জাতি সম্বন্ধে অর্ম্যান সাহেব লিখিয়াছেন,—“The Chuckchi offer to travellers, who chance to visit them, their wives, and also what we should call their daughters, honour.” কাপ্তেন লায়ন এবং স্যার জন লবক, এসকুইমো, কামস্কট্কানিবাসী ও কালমুখ্দের সম্বন্ধেও ঠিক এমনি অতিথিসেবার ইতিহাস লিখিয়া গিয়াছেন। হারবার্ট স্পেন্সর তাঁহার Descriptive Sociology গ্রন্থে এমনি বহুতর দয়ার কাহিনী প্লস্ ও প্যালাস সাহেবদের ভ্রমণবৃত্তান্ত হইতে সংগ্রহ করিয়া গিয়াছেন। জিজ্ঞাসা করি, ইহাদের সহিত আমাদের ধার্মিক বণিকটির প্রভেদ কোন্খানে? সে-দেশের পুরুষেরাও যাহা কর্তব্য এবং ধর্ম বলিয়া মনে করিয়াছে, তাহাই পালন করিয়াছে—ইনিও তাই; অতিথিকে সন্তুষ্ট করিবার ইচ্ছা উভয়েরই সমান, উভয়েই মনে করিয়াছে, অতিথি সন্তুষ্ট না হইলে আমার পাপ হইবে, আমি কষ্ট পাইব। কথাটাকে যেমন ইচ্ছা এবং যত ইচ্ছা ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিলেও ওই একটা ‘আমি’ ছাড়া আর কিছুই পাইবার জো নাই। ওই ‘আমি’টার মধ্যেই নারীর প্রতি সম্মান শ্রদ্ধা যে কোথায় ডুবিয়া গিয়াছে, তাহার কোন চিহ্নই পাওয়া যায় না।