আগে খাজনা দাও, তারপরে অনুসন্ধান করব।” প্রজারা বললে, “না।” নেতারা জমা হয়ে সরকারকে জানালেন, এটা নিছক অর্থনৈতিক বিবাদ—একেবারেই রাজনৈতিক নয়। গভর্নমেন্ট কান দিলে না, অল্পস্বল্প অত্যাচারেই উৎপীড়ন শুরু হল—কতকটা যেমন ইউনিয়ন বোর্ড উপলক্ষে মেদিনীপুরে সেবারে হয়েছিল। ছোট-বড় যেখানে যত নেতা ছিলেন, রৈ রৈ শব্দ করতে লাগলেন; খবরের কাগজগুলোর একটা মোচ্ছোপ লেগে গেল। লাখে লাখে টাকা গিয়ে পড়ল বারদোলীতে,—যুদ্ধ চলতে লাগল। যুদ্ধ ততদিন থামল না, যতদিন না সরকারের সন্দেহ দূর হল যে, প্রজারা সত্যই ব্রিটিশ রাজত্ব উলটে দিতে চায় না,—তারা চায় শুধু একটু Inquiry এবং সম্ভবপর হয়ত কিছু খাজনার মাপ, শুধু একটা ন্যায়বিচার। মোটামুটি এই এর ইতিহাস। বাঙ্গালাদেশে একে কখনও ব্রিটিশের হার বলে ভেবো না, কিংবা political সংঘর্ষকে economical ঝগড়া বলেও কখনো ভুল করো না,—সে repression–এর চেহারাই আলাদা। কাজে যদি কখনো নামো, যেমন নেমেছিলে বিগত কংগ্রেস Volunteer Organisation-এ-যার সমতুল্য ভারতের কোথাও আজও হয়নি,—তখন আত্ম-বঞ্চনায় নিজেকে এবং দেশকে ঠকিয়ো না। তবে, ভরসা এই যে, এখানে উপস্থিত সভ্যদের মাঝে বয়োজ্যেষ্ঠ অনেকে আছেন যাঁরা ইংরেজের সে মূর্তিকে ভালো করেই চেনেন। যার যা যথার্থ মূল্য, তা জানাবার জন্যই আমার এত কথা বলা। অসম্মানের লেশমাত্রও উদ্দেশ্য নেই।
অনেক সময় নিলাম। অভিভাষণটা হয়তো অযথা দীর্ঘ হয়ে গেল। পরিশেষে একটা কথা বলে শেষ করব—সে, দেশে শিক্ষা—বিস্তারের কথা। যে শিক্ষা সভ্যজগতের প্রজারা দাবী করে, সে শিক্ষা-বিস্তার গভর্নমেন্টের ঐকান্তিক চেষ্টা ব্যতিরেকে ব্যক্তিবিশেষের চেষ্টায় হয় না। করতে মানা আমি করিনে, কিন্তু এখানে একটা night school, আর ওখানে একটা আশ্রম, বিদ্যাপীঠ খুলে যা হয়, তা ছেলেখেলার নামান্তর। তা সে যাই হোক, লেখাপড়া ছাড়া তার অন্য প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু এ কথা যাঁরা বলেন যে, দেশের সবাই লেখাপড়া না শেখা পর্যন্ত আর গতি নেই, মুক্তির দ্বার আমাদের একান্ত অবরুদ্ধ, এবং এইজন্যে সকল কর্ম পরিত্যাগ করে লেখাপড়া শেখান নিয়েই ব্যতিব্যস্ত, তাঁরা ভাল লোক সন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁদের পরে আমার ভরসা কম। এইবার শেষ করি। মুসলমান ভাইদের সম্বন্ধে আলাদা করে কিছুই বলার আবশ্যক মনে করিনি—কেননা, তাঁরাও দেশের এই তরুণ-সংঘের অন্তর্গত। তরুণেরা তরুণ—জাতি—তাদের আর কোনো নাম নেই।
তোমরা ভালবেসে এতদূর আমাকে টেনে এনেছ, তার জন্য তোমাদের ধন্যবাদ দিই।
সত্য মনে করে অনেক অপ্রিয় কথা বলেছি। পুরস্কার তার তোলা রইল। এই কংগ্রেসমণ্ডপেই দু’দিন পরে তিরস্কারের বান ডেকে যাবে। কিন্তু তখন আমি হাবড়ার নিভৃত পল্লী মাজুতে গিয়ে সাহিত্যের দরবারে ভিড়ে যাব, এখানকার তর্জনগর্জন কানে পৌঁছবে না—এইটকুই ভরসা। *
*১৯২৯ সালের ঈস্টারের ছুটিতে, রংপুরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সম্মিলনীর অব্যবহিত পূর্বে, বঙ্গীয় যুব — সম্মিলনীর সভাপতির আসন হইতে প্রদত্ত বক্তৃতা।
নারীর মূল্য
মণি-মাণিক্য মহামূল্য বস্তু, কেন না, তাহা দুষ্প্রাপ্য। এই হিসাবে নারীর মূল্য বেশী নয়, কারণ, সংসারে ইনি দুষ্প্রাপ্য নহেন। জল জিনিসটা নিত্য-প্রয়োজনীয়, অথচ ইহার দাম নাই। কিন্তু যদি কখন ঐটির একান্ত অভাব হয়, তখন রাজাধিরাজও বোধ করি একফোঁটার জন্য মুকুটের শ্রেষ্ঠ রত্নটি খুলিয়া দিতে ইতস্ততঃ করেন না। তেমনি—ঈশ্বর না করুন, যদি কোনদিন সংসারে নারী বিরল হইয়া উঠেন, সেই দিনই ইঁহার যথার্থ মূল্য কত, সে তর্কের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হইয়া যাইবে—আজ নহে। আজ ইনি সুলভ।
কিন্তু দাম যাচাই করিবারও একটা পথ পাওয়া গেল। অর্থাৎ পুরুষের কাছে নারী কখন, কি অবস্থায়, কোন্ সম্পর্কে কতখানি প্রয়োজনীয়, তাহা স্থির করিতে পারিলে নগদ আদায় হউক আর না হউক, অন্ততঃ কাগজে-কলমে হিসাব-নিকাশ করিয়া ভবিষ্যতে একটা নালিশ-মকদ্দমারও দুরাশা পোষণ করিতে পারা যায়। একটা উদাহরণ দিয়া বলি। সাধারণতঃ, বাটীর মধ্যে বিধবা ভগিনীর অপেক্ষা স্ত্রীর প্রয়োজন অধিক বলিয়া স্ত্রীটি বেশি দামী। আবার এই বিধবা ভগিনীর দাম কতকটা চড়িয়া যায় স্ত্রী যখন আসন্ন-প্রসবা; যখন রাঁধা-বাড়ার লোকাভাব, যখন কচি ছেলেটাকে কাক দেখাইয়া বক দেখাইয়া দুইটা খাওয়ান চাই। তাহা হইলে পাওয়া যাইতেছে—নারী ভগিনী-সম্পর্কে বিধবা অবস্থায়, নারী ভার্যা-সম্পর্কীয়ার অপেক্ষা অল্প মূল্যের। ইহা সরল স্পষ্ট কথা। ইহার বিরুদ্ধে তর্ক চলে না! একটা শ্লেট-পেন্সিল লইয়া বসিলে নারীর বিশেষ অবস্থার বিশেষ মূল্য বোধ করি আঁক কষিয়া কড়া-ক্রান্তি পর্যন্ত বাহির করা যায়। কিন্তু কথা যদি উঠে, ইহার অবস্থা-বিশেষের মূল্য না হয়, একরকম বোঝা গেল, কিন্তু নারীত্বের সাধারণ মূল্য ধার্য করিবে কি করিয়া, যখন ইঁহার জন্য সোনার লঙ্কা নিপাত হইয়াছিল, ট্রয়-রাজ্য ধ্বংস হইয়া গিয়াছিল; আরও ছোট-বড় কত রাজ্য হয়ত ইতিপূর্বে নষ্ট হইয়া গিয়াছে, ইতিহাস সে কাহিনী লিপিবদ্ধ করিয়া রাখে নাই। এখানে এতবড় প্রয়োজন নারীতে কি ছিল যে সাম্রাজ্য ভাসাইয়া দিতেও মানুষ পরাঙ্মুখ হয় নাই, প্রাণ দিতেও দ্বিধা করে নাই। তোমার শ্লেটখানিতে জায়গা কত যে ইহার দাম তুমি কষিয়া বাহির করিয়া দিবে? কথাটা বাহিরের দিক হইতে অস্বীকার করি না, কিন্তু ভিতরের দিকে চাহিয়া আমি যদি প্রশ্ন করি, মানুষ রাজ্যের দিকে চাহিয়া দেখে নাই সত্য, কিন্তু তাহা কতটা যে নারীর দিকে চাহিয়া, আর কতটা যে নিজের অসংযত উচ্ছৃঙ্খল প্রবৃত্তির দিকে চাহিয়া—সে জবাব আমাকে কে দিবে?