ইহার ব্যতিক্রম দেখিতে পাওয়া যায় একমাত্র ইসলাম-ধর্মে। যদিও নারীর স্থানটি কোরানের মতে ঠিক কোন্খানে, তাহা বুঝাইয়া বলা অতি কঠিন, তথাপি মহম্মদ নারীজাতিকে যে শ্রদ্ধার চোখে দেখিতে আদেশ করিয়া গিয়াছেন, পুত্র-কন্যার মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান সৃষ্টি করিয়া তুলিতে নিষেধ করিয়া গিয়াছেন, বিশেষ করিয়া বিধবাকে— যাহার অবস্থা আরব ও ইহুদীদের মধ্যে সবচেয়ে শোচনীয় ও নিরুপায় ছিল—তাহাকে দয়া ও ন্যায়ের দৃষ্টিতে দেখিতে হুকুম করিয়া গিয়াছেন, এ-সব কথা অস্বীকার করা যায় না।
বস্তুতঃ তদানীন্তন আরব-রমণীর ভয়ংকর অবস্থার তুলনায় আরবের নব-ধর্ম যে নারীকে সহস্রগুণে উন্নত করিয়াছে তাহাতে লেশমাত্র সংশয় থাকিতে পারে না। Hornback, Ricaut প্রভৃতি গ্রন্থকারেরা কি ভাবিয়া যে প্রচার করিয়া গিয়াছেন, মুসলমানদের মতে নারীর আত্মা নাই এবং নারীকে তাহারা পশুর মত মনে করে, তাহা বলিতে পারি না। আমি ত কোরানের কোথাও এমন কথা দেখিতে পাই নাই। বরং কোরানের তৃতীয় অধ্যায়ের শেষের দিকে এই যে একটা উক্তি আছে‚ মৃত্যুর পর দুষ্কৃতকারীকে ঈশ্বর শাস্তি দেন—তিনি নর-নারীর প্রভেদ করেন না—তাহা দেখিয়া মনে হয়, মহম্মদ নারীর আত্মা অস্বীকার করেন নাই। কোরানের চতুর্থ অধ্যায়ে এবং আরও অনেক স্থানেই নারীর প্রতি সদয় ব্যবহারের কথা ও তাহার ন্যায্য অধিকারের বিষয় এই ধর্মগ্রন্থে পুনঃ পুনঃ আলোচিত হইয়াছে। তথাপি অনেকের বিশ্বাস, ইসলাম-ধর্মে নারীর স্থান বড় নীচে; এটা বোধ করি পুরুষের বহু-বিবাহের অনুমতি আছে বলিয়াই। চতুর্থ অধ্যায়ের গোড়াতেই আদেশ আছে, “take in marriage of such other women as please you, two or three or four and nomore.” এ ছাড়া বিশ্বাসী এবং সাধু লোকেরা স্বর্গে গিয়া কিরূপ সুখ-সম্পদ আমোদ-আহ্লাদ ভোগ করিতে পাইবেন, সে-সম্বন্ধে মহম্মদ অনেক আশা দিয়া গিয়াছেন। স্বর্গে প্রতি বিশ্বাসীর নিমিত্ত কিরূপ ও কতগুলি করিয়া হুরানি নির্দিষ্ট হইবে, তাহার পুঙ্খানুপুঙ্খরূপ আলোচনা আছে, কিন্তু মর্ত্যের মানবীর অবস্থাটা স্বর্গে কিরূপ দাঁড়াইবে এবং সেইরূপ দাঁড়ান বাঞ্ছনীয় কি না তাহা নিঃসঙ্কোচে বলা যায় না। Sale সাহেব তাঁহার কোরানের অনুবাদের একস্থানে লিখিয়াছেন, “but that good women will go into a separate place of happiness, where they will enjoy all sorts of delights; but whether one of those delights will be the enjoyment of agreeable paramours created for them, to complete the economy of the Mahamedan system, is what I have found nowhere decided.” এই যদি হয়, এত করা সত্ত্বেও যে নারীর যথার্থ অবস্থা-সম্বন্ধে লোকের দারুণ সংশয় ও মতভেদ ঘটিবে, তাহা বিচিত্র নয়। তা ছাড়া মহম্মদ নিজেও একস্থানে বলিয়াছেন, “when he took a view of paradise, he saw the majority of its inhabitants to be the poor, and when he looked down into hell, he saw the greater part of the wretches confined there to be women!”
যাঁহারা মনে করেন সংসারে নারী প্রয়োজনের অতিরিক্ত থাকার জন্যই স্বভাবতঃ তাহার হীন মূল্য নির্দিষ্ট হইয়াছে, তাঁহারা যে সম্পূর্ণ ভুল করেন এ কথা বলি না। কারণ, যে-দেশেই মানুষ লড়াই করাটাই পুরুষের পরম গৌরবের বস্তু বলিয়া ধরিয়া লইয়াছে এবং সেই হিসাবে লড়াই করিয়াছে এবং লোকক্ষয় করিয়া বাহ্যতঃ নিজেদের নারীর অনুপাত বৃদ্ধি করিয়াছে, সেই দেশেই নারীর মূল্য হ্রাস হইয়াছে।
এ কথা সত্য হইলেও, এ কথাটাও বুঝিয়া দেখিবার বিষয়, বাস্তবিক নারীর অনুপাত তাহাতে বৃদ্ধি হয় কি না। কারণ, এই কথাটা অনেকেই গণনার মধ্যে আনেন না যে, প্রায় সমস্ত যুদ্ধপ্রিয় জাতিই নিজেদের নারীর অনুপাত বৃদ্ধি না পাইবার দিকে প্রখর দৃষ্টি রাখিয়া থাকে। প্রধান উপায় নিজেদের শিশু-কন্যা হত্যা করিয়া। প্রায় সমস্ত আদিম অসভ্য জাতিরা শিশু-কন্যা বধ করিয়া ফেলিত। রাজপুতেরা করিত, আরব শেখেরা কন্যা জন্মিবামাত্রই গর্ত কাটিয়া পুঁতিয়া ফেলিত, কেঁধাপ্রদেশের আরবেরা শিশু-কন্যার পাঁচ বৎসর বয়সে তাহাকে হত্যা করিবার পূর্বে কন্যার জননীকে সম্বোধন করিয়া বলিত, “এইবার মেয়েকে গন্ধ মাখাইয়া দাও, সাজাইয়া দাও, আজ সে তার মায়ের ঘরে যাইবে!” অর্থাৎ, কূপের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হইবে। কোরিশের লোকেরা মক্কার নিকটবর্তী আবুদেলামা পাহাড়ে নিজেদের কন্যা বধ করিত। প্রাচীন গ্রীক ঐতিহাসিক স্ট্রাবো বলিয়া গিয়াছেন, “the practice of exposing female infants and putting them to death being so common among the ancients, that is remarked as a thing very extra-ordinary in the Egyptians, that they brought up all their children.” চীনাদের মধ্যে শুনিয়াছি এ প্রথা আজও আছে। গ্রীকদের সম্বন্ধে Posidippus-এর একটা প্রচলিত উক্তি Sale উদ্ধৃত করিয়াছেন, “a man, though too poor, will not expose his son; but if he is rich, will scarce preserve his daughter.”
সুতরাং লড়াই করিয়া নিজেরা মরিলে, বা কন্যা হত্যা করিলে নারীর অনুপাত বাড়ে না, কমেও না, অনুপাতের উপর নারীর সম্মান বা অসম্মান (মূল্য) নির্ভরও করে না। করে পুরুষের এই ধারণার উপর—নারী সম্পত্তি, নারী শুধু ভোগের বস্তু! তাই নিজেদের কন্যা বধ, তাই পরের কন্যা হরণ করিয়া আনিবার প্রথা! নিজেদের কন্যা পরে লইয়া গেলে মহা অপমান, পরের মেয়ে কাড়িয়া আনিতে পারিলে মহা গৌরব! এই জন্যই এক পুরুষের বহু স্ত্রী সম্মান ও বলের চিহ্ন। Burckhardt বলিয়াছেন এই ধারণা ওয়াহাবিদের মধ্যে আজও এত প্রবল যে, তাহারা ইউরোপের এক পুরুষের একটিমাত্র স্ত্রীর কথা শুনিয়া বিস্ময়ে হাঁ করিয়া থাকে। কথাটা সত্য বলিয়া তাহারা মনের মধ্যে বিশ্বাস পর্যন্ত করিতে পারে না।