Monogamy যাহা নারীর যথার্থ সম্মানের ঠাঁই, এবং যাহা একমাত্র নর-নারীর প্রকৃত স্বাভাবিক বন্ধন, সে ধারণাই প্রায় এ দেশে নাই। অথচ, সতীত্বের এত অপর্যাপ্ত রীতি-নীতি, এটা বজায় রাখিবার এত অদ্ভুত ফন্দি আর কোন দেশে কোনদিন উদ্ভাবিতও হয় নাই। মনে হইতেছে, কোন এক মস্তবড় লোকের লেখায় পড়িয়াছি, আমাদের দেশ সমস্ত রকম সামাজিক প্রশ্নের যে একটা বড় রকম উত্তর দিয়াছেন, তাহা এখনও জগতের সম্মুখে আছে, এবং তাহার সফলতা অনিবার্য, না, কি এমনি একটা কথা। কি জানি আমাদের দেশ কি বড় উত্তর দিয়াছিল, এবং জগতের কাহারা সে-জন্য হাঁ করিয়া বসিয়া আছে, কিন্তু ফল যে তাহার অনিবার্য হইয়া উঠিয়াছে, তাহা টের পাওয়া যাইতেছে। তাঁহার দেখাদেখি আরো অনেকেযাঁহারা সামাজিক ইতিহাসের কোন ধার ধারেন না, তাঁহারাও এই সমস্ত কল্পনার ধুয়া গাহিতে শুরু করিয়াছেন। ‘বড় রকম উত্তর দিয়াছিল’, ‘সমস্ত সামাজিক প্রশ্ন’, ‘জগতের সম্মুখে আছে’, ইত্যাদি বুলির অর্থ বোঝাও যেমন শক্ত, এই-সব সাহিত্যিক verbiage- এর প্রতিবাদ করিতে পারাও ততোধিক কঠিন। অন্যান্য জাতি চোখের উপর দিন দিন বড় হইয়া যাইতেছে, নর-নারী মিলিয়া পতিত সমাজটাকে দুইদিনে ঠেলিয়া উপরে তুলিয়া ধরিতেছে, যে যাহার ন্যায্য অধিকারের মধ্যে চলাফেরা করিয়া উন্নত হইয়া উঠিতেছেতবু সে-সব কিছুই নয়। আর আমাদের দেশের সেই অবোধ্য বড় উত্তরটাই মস্তবড় এবং তাহার ভবিষ্যৎ কাল্পনিক সফলতাটাই সর্বোপরি বাঞ্ছনীয়। সেই জাতিভেদের অসংখ্য সঙ্কীর্ণতা, বালিকা-বিবাহ, বিবাহ না দিলে জাত যাওয়া, বারো বছরের বিধবা মেয়েকে দেবী করার বাহাদুরি, পঞ্চাশ বছরের বুড়ার সহিত এগারো বছরের মেয়ের বিবাহ এবং তাহার বছর-দুই পরেই তাহার গর্ভের সন্তান—এই-সমস্তই বড়-রকমের উত্তর। অথচ কথাটি বলিবার জো নাই। পণ্ডিতেরা হাঁ-হাঁ করিয়া ছুটিয়া আসিয়া বলিবেন, “তুমি আমাদের মুনি-ঋষিদের চেয়ে বেশি বোঝ?” মনে পড়ে, সেই আম কেনার কথা। লোকটা বলিল, “চেখে নিন—মিষ্টি গুড়।” খেয়ে দেখি তত টক আমার জীবনে খাই নাই। কিন্তু লোকটাকে কিছুতেই স্বীকার করাইতে পারিলাম না। সে ক্রমাগত চেঁচাইয়া বলিতে লাগিল, “টক বললেই শুনব? আমার গাছের আম আমি জানিনে!” এর আর উত্তর কি?
ইংরাজীতে যাহাকে ethics বলে, তাহার একটা গোড়ার কথা এই যে, বিসদৃশ হেতু না থাকিলে আমার স্বাধীনতাটা কেবল ততদূর পর্যন্ত টানিয়া লইয়া যাইতে পারি যতক্ষণ না তাহা আর একজনের তুল্য স্বাধীনতায় আঘাত করে। এই দুটো কথার দ্বারা মানুষের প্রায় সমস্ত কাজ নিয়ন্ত্রিত করা যাইতে পারে, এবং আমার বিশ্বাস, যে-কোন সামাজিক প্রশ্নের স্থানও ইহারই মধ্যে সঙ্কুলান হয়। ইহাকে যে সমাজ যত বেশি অগ্রাহ্য করিয়া চলিয়াছে, সে তত বেশী নারীর উপর অন্যায় করিয়াছে, এবং তাহার প্রাপ্য অংশ হইতে তাহাকে বঞ্চিত করিয়া নারীকেও নত করিয়াছে, নিজেরাও অবনত হইয়াছে। একটা দৃষ্টান্ত দিয়া বলি।
একটি কন্যা হয়ত রুগ্না, দুর্বল, অশিক্ষিতা এবং অপটু তত্রাচ একটা বিশেষ বয়সে তাহার বিবাহ দিতেই হইবে, অর্থাৎ মাতৃত্বের গুরুভার তাহাকে মাথায় তুলিতেই হইবে; অথচ, আর একটি বিধবা মেয়ে হয়ত সবল সুস্থ, শিক্ষিতা এবং মাতৃত্বের সম্পূর্ণ উপযোগিনী—আদর্শ জননীর সমস্ত সদ্গুণে হয়ত ভগবান তাহাকে ভূষিত করিয়াছেন, তবুও তাহাকে তাহার স্বাভাবিক ন্যায়সঙ্গত অধিকার হইতে বঞ্চিত করিতে হইবে! ইহাতে শাস্ত্রকারের মর্যাদা যদি-বা বজায় থাকে, ধর্মের মর্যাদা যে বজায় থাকে না, তাহা নিসংশয়ে বলিতে পারা যায়। প্রথমটাতেও না, পরেরটাতেও না।
সুসভ্য মানবের সুস্থ সংযত শুভবুদ্ধি যে অধিকার রমণীজাতিকে সমর্পণ করিতে বলে, তাহাই মানবের সামাজিক নীতি এবং তাহাতেই সমাজের কল্যাণ হয়। কোন একটা জাতির ধর্মপুস্তকে কি আছে না আছে তাহাতে হয় না। নারীর মূল্য বলিতে আমি এই নীতি ও অধিকারের কথায় এতদূর পর্যন্ত বলিয়া আসিয়াছি। Supply এবং demand-এর মূল্যও বলি নাই, কবে পুরুষ বাড়িয়া উঠিবে, কবে নারী বিরল হইবে, সে আশাও করি নাই। নারীর মূল্য নির্ভর করে পুরুষের স্নেহ, সহানুভূতি ও ন্যায়-ধর্মের উপরে। ভগবান তাহাকে দুর্বল করিয়াই গড়িয়াছেন, বলের সেই অভাবটুকু পুরুষ এই সমস্ত বৃত্তির মুখের দিকে চাহিয়াই সম্পূর্ণ করিয়া দিতে পারে, ধর্মপুস্তকের খুঁটিনাটি ও অবোধ্য অর্থের সাহায্যে পারে না। ইহার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জাপান। সে কেবল তাহার নারীর স্থান উন্নত করিতে পারিয়াছে সেইদিন হইতে, যেদিন হইতে সে তাহার সামাজিক রীতি-নীতির ভালো-মন্দর বিচার ধর্মের এবং ধর্ম-ব্যবসায়ীর আঁচড়-কামড়ের বাহিরে আনিয়া ফেলিয়াছে। কিছুদিন পূর্বেও সেখানে চীনাদের মত নারীর দুর্দশার সীমা-পরিসীমা ছিল না। শুধু ইউরোপ সম্বন্ধেই “The clergy have been the worst enemies of women, women are their best friends’ নয়, অনেক দেশের সম্বন্ধেই ঠিক তাই। নারীর স্থান অবনত করিবার জন্য ধর্ম-ব্যবসায়ীর স্পর্ধা যে কতদূর বাড়িতে পারে, তাহা St. Ambrose-এর একটা উক্তি হইতে জানা যায়। তিনি অসংশয়ে প্রচার করিয়াছিলেন, “marriage could not have been God’s original theme of creation.” গডের অভিপ্রায়টুকু পর্যন্ত তাহাদের অগোচর থাকে না, কিন্তু কাহার সাধ্য তাহাকে অবিশ্বাস করে!