আরো একটা কথা। সামাজিক নিয়ম-সম্বন্ধে যাঁহারাই আলোচনা করিয়া তাঁহাদের পরিশ্রমের ফল লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন, তাঁহারা এ সত্যটাও আবিষ্কার করিয়া গিয়াছেন যে, সমাজে নারীর স্থান অবনত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের স্থান আপনি নামিয়া আসে। কেন হয়, এবং হওয়াটা স্বাভাবিক কি না, এ কথা বুঝিতে পারা কঠিন নহে। আমিও ইতিপূর্বে কয়েকটা দৃষ্টান্ত দিয়া বলিয়াছি, শিশুর জননীর সহিত যত ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ, পিতার সহিত তত নয়।
এই কারণেই সংসারে কৃতী লোকের জীবনী আলোচনা করিলে দেখা যায়, তাঁহারা সকলেই এমন মা পাইয়াছিলেন যাহাতে সংসারে উন্নতি করা অসম্ভব হইয়া উঠে নাই। কিন্তু, এই মায়ের অবস্থাটা সাধারণতঃ যদি দিন দিন নামিয়া পড়িতে থাকে, এবং তাহার অবশ্যম্ভাবী ফলে দেশের কৃতী সন্তানের সংখ্যা কমিয়া আসিতেই থাকে, এই প্রতিযোগিতার দিনে সে জাতি, আর জাতির মত জাতি হইয়া বাঁচিয়া থাকিতে পারে না। তবে এতকাল টিকিয়া রহিল কিরূপে? এই বলিয়া জবাবদিহি করিতে যাঁহারা চান তাঁহাদের শুধু এইটুকুমাত্রই বলিতে চাই যে, কোনমতে কেবল প্রাণধারণ করিয়া থাকাটাই মানুষের বাঁচা নয়।
সমাজে নারীর স্থান নামিয়া আসিলে নর-নারী উভয়েরই অনিষ্ট ঘটে, সে-সম্বন্ধে বোধ করি মতভেদ থাকিতে পারে না, এবং এই অনিষ্টের অনুসরণ করিলেই যে নারীর স্থান নির্দিষ্ট হইতে পারে, তাহাও বুঝিতে পারা কঠিন ব্যাপার নয়। সমাজ মানে নর-নারী। শুধু নরও নয়, শুধু নারীও নয়। উভয়েরই কর্তব্য সম্যক্ প্রতিপালিত হইতেছে কি না! কর্তব্য বলিতে শুধু নিজের কাজটাই বুঝায় না, অপরকেও ঠিক ততটা কাজ করিবার অবকাশ দেওয়া হইতেছে কি না, তাহাও বুঝায়। সেইটুকুই বুঝিতে বলিতেছি।
আরো একটা কথা এই যে, পুরুষের সমস্ত কাজ নারীর করিতে পারে না, নারীর সমস্ত কাজও পুরুষে করিতে পারে না; কিংবা যে কর্তব্য দু’জনে মিলিয়া করিলে তবেই সুসম্পন্ন হয়, তাহাও শুধু একার দ্বারা সর্বাঙ্গসুন্দর হইতে পারে না। অতএব, সমস্ত সমাজেরই দেখা উচিত তথায় নারীর কর্তব্য প্রতিপালিত হইতেছে কি না। এবং কাজ করিবার ন্যায্য স্বাধীনতা ও প্রশস্ত স্থান তাহাদিগকে ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছে কি না। জেলের কয়েদীদিগের কাছেও ভাল কাজ আদায় করিয়া লইতে হইলে তাহাদের শৃঙ্খলের ভার লঘু করিয়া দেওয়া প্রয়োজন। অবশ্য শৃঙ্খল একেবারে মুক্ত করিয়া দিবার কথা বলিতেছি না—তাহাতে আমেরিকার মেয়েদের দশা ঘটে। তাহাদের অবাধ স্বাধীনতা উচ্ছৃঙ্খলতায় পর্যবসিত হইয়াছে। একদিন প্রাচীন রোমে আইন পাশ করিতে হইয়াছিল, “to prevent great ladies from becoming public prostitutes.” কোথাও একবার পড়িয়াছিলাম, তিব্বতের এক স্ত্রীর বহু-স্বামিত্বের প্রসঙ্গে গ্রন্থকার বোধ করি একটুখানি পরিহাস করিয়াই বলিয়াছেন—এ-সব কথা লিখিতে ভয় হয়, পাছে আমেরিকার নারীরাও খেয়াল ধরিয়া বসে, আমরাও ওই চাই! তাহাদের ব্যাপার দেখিয়া প্রায় সমস্ত পুরুষেরই হাত-পা পেটের মধ্যে ঢুকিয়া যাইবার মত হইয়াছে। তাই কতকটা শৃঙ্খলের প্রয়োজন। অপরপক্ষে শৃঙ্খল একেবারে ঝাড়িয়া ফেলিয়া দিলে পুরুষেরাও যে কত অবিচারী, উদ্ধত, উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠে, এই ভারতবর্ষেই সে দৃষ্টান্তের অসদ্ভাব নাই।
যাই হউক, কথা হইতেছিল কাজ করিবার ন্যায্য স্বাধীনতা এবং ন্যায্য স্থান ছাড়িয়া দেওয়া, এবং কোন্ কাজটা কাহার, এবং কোন্ কাজটা উভয়ের এই মীমাংসা করিয়া লওয়া।
কারণ, দেখা গিয়াছে যেখানে সুবিধা এবং সুযোগ মিলিয়াছে সেখানে নারী পুরুষ অপেক্ষা একতিলও কম নিষ্ঠুর বা কম রক্তপিপাসু নয়! এখানে এইটাই দেখিবার বিষয় যে, পুরুষ যদি এই বলিয়া জবাবদিহি করে, সে দুর্বলের উপর গায়ের জোর খাটাইয়া কর্তৃত্ব করে নাই, বুঝিয়া-সুঝিয়া ধীরস্থিরভাবে বিবেচনা করিয়া কর্তব্য এবং মঙ্গলের খাতিরেই বাধ্য হইয়া নারীর এই নিম্নস্থান নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছে, তাহা হইলে সে কথা সত্য নয়।
অবশ্য স্পেন্সরের এই মত সকলেই যে বিনা-প্রতিবাদে স্বীকার করিয়া লইয়াছেন তাহা নহে, কিন্তু যতগুলা বিভিন্ন প্রতিবাদ অন্ততঃ আমার চোখে পড়িয়াছে তাহাতে স্পেন্সরের মতটাই সত্য বলিয়া মনে হইয়াছে। তিনি বলিয়াছেন, “militancy implies pre-dominance of compulsory co-operation” এবং তাহার অবশ্যম্ভাবী ফলের উল্লেখ করিয়া লিখিতেছেন, “Hence the disregard of women’s claims shown in stealing and buying them; hence the inequality of status between the sexes entailed by polygamy, hence the use of women as labouring Slaves; hence the life-and-death power over wife and child; and hence that constitution of the family which subjects all its members to the eldest male. Conversely, the type of individual nature developed by voluntary co-operation in societies that are predominantly industrial, whether they be peaceful simple tribes, or nations that have in great measure outgrown militancy, is a relatively-altruistic nature.”
বাস্তবিক এই compulsory co-operation যেখানে এত ‘binding’ তা লড়ায়ের জন্যই হউক, আর পরকালের জন্যই হউক, নারীর অবস্থা সেখানেই তত হীন। ধর্মের গোঁড়ামি, অধর্মের অত্যাচার নারীকে যে কত নিচু করিয়াছিল ইউরোপের মধ্যযুগ তাহার বড় প্রমাণ। প্রবন্ধের প্রারম্ভেই তাহার কতকটা ইঙ্গিত দিয়া গিয়াছি, এবং আবশ্যক হইলে আরও শতশহস্র দেওয়া যাইতে পারিত, কিন্তু সে আবশ্যক আশা করি নাই। ধর্মের গোঁড়ামি কেন নারীকে হীন করিল, সে আলোচনা এ প্রবন্ধে অপ্রাসঙ্গিক হইবে, সুতরাং তাহাতে বিরত রহিলাম। শুধু এই স্থূল কথাটা বলিয়া রাখিব যে, ধর্মের বাড়াবাড়ির প্রধান উপাদান বিরক্তি। যা-কিছু সাংসারিক লোকের প্রার্থিত তাহাতেই আসক্তি নাই, এই ভাবটা দেখানো। বিষয়-আশয় টাকাকড়ি অতি বদ্ জিনিস—নারীও তাই। ‘The devil’s gate’ ‘নরকস্য দ্বারো নারী’ এইজন্যই শ্রেষ্ঠ ধর্মচর্চার বীজমন্ত্র। অর্থাৎ, যদি পরকালের কাজ করিতে চাও ত তাহাকে নরকের দ্বারস্বরূপ জ্ঞান কর, আর যদি ইহকালের কাজ করিতে চাও ত, আমাদের দেশের যে ব্যবস্থা ছিল তাই কর। যতগুলা পার বিবাহ কর,—তার আট-দশ রকম পথ আছে, এবং মরিলে যেমন করিয়া পার সঙ্গে করিয়া লইয়া যাও। না পার অন্ততঃ জুজুর ভয় দেখাইয়া তাহাকে জড়ভড়ত করিয়া রাখিয়া যাও।