সেইজন্যই ডাক্তার Francis Day রিপোর্ট দিয়াছিলেন, আন্দামান দ্বীপবাসীরা ‘are fast dying out’ এবং অনেক অনুসন্ধান করিয়াও তিনি এমন একটি জননী খুঁজিয়া পান নাই যাহার একসঙ্গে তিনটি সন্তানও জীবিত আছে। আমেরিকার কুচিল জননীরা সন্তান পীড়িত হইয়া পড়িলেই বনের ভিতর ফেলিয়া দিয়া আসে। হারবার্ট স্পেন্সর Savage Life and Scenes in Australia and New Zealand (by G. F. Angas)-এর উল্লেখ করিয়া বলিয়াছিলেন, Angas সাহেবের কথা বিশ্বাস করিতে প্রবৃত্তি হয় না যে, সত্যই অস্ট্রেলিয়ার অসভ্যেরা অভাবে নিজেদের জীবন্ত ছেলেমেয়েদের বঁড়শিতে গাঁথিয়া কুমীর হাঙ্গর ধরিবার টোপ (bate) প্রস্তুত করে এবং চর্বি লইয়া মাছ ধরে। কিন্তু তাঁহার কথা অবিশ্বাস করিবার বিশেষ হেতু নাই। কারণ, অনুসন্ধান করিলে দেখিতে পাওয়া যায়, যে-কোন দেশে যে-কোন জাতির মধ্যে সমাজে নারীর স্থান নীচে নামিয়া আসিবার সঙ্গেই শিশুর স্থান আপনি নামিয়া আসে। এ শুধু মানবের নিম্নস্তরের কথা নহে। অপেক্ষাকৃত উন্নত স্তরেও চোখ ফিরাইলে দেখিতে পাওয়া যাইবে যে, নারী যেখানে উপেক্ষার পদার্থ, জাতির মেরুদণ্ডস্বরূপ শিশুরাও সেখানে উপেক্ষা অবহেলার জিনিস। এ কথার সত্যতা উদাহরণ দিয়া প্রমাণ করিতে যাওয়া বিড়ম্বনা মাত্র। সে-জাতির ভবিষ্যত উত্তরোত্তর অন্ধকার হইয়াই আসিতে থাকে। কিন্তু নর-নারীর শিথিল বন্ধনই তাহার একমাত্র হেতু বলিয়া যাঁহারা মনে করেন, তাঁহারা ভুল করেন। নারী উপেক্ষিত ক্রীড়ার সামগ্রী,—এইটিই সর্বপ্রধান হেতু। হারবার্ট স্পেন্সর তাঁহার Sociology গ্রন্থে আদিম মানবের Strong emotion-এর দোহাই পাড়িয়া কি করিয়া এই বিষয়টার মীমাংসা করিতে চাহিয়াছেন ঠিক বুঝিতে পারা যায় না। রাগের মাথার “Will slay a child for letting fall something it was carrying.” ‘ইমোশন’ হইতে পারে, কিন্তু “kill their children without remorse on various occasion,” মাছ ধরিবার টোপের জন্য ছেলে মারিয়া ধীরে ধীরে তাহার চর্বি বাহির করা, কিংবা desert sick children কি করিয়া ঠিক ‘ইমোশন’ হইতে পারে বলিতে পারি না। আর তাহাও যদি হয়, তাহাতেও আমার কথাটা অস্বীকৃত হয় না। আদিম মানবের যত কিছু দোষ থাকিবার তাহা ত আছেই, নর-নারীর বন্ধন প্রায় সর্বত্রই শিথিল, সেকথা ত বটেই, কিন্তু তাহাতেও তাহার সামাজিক অবস্থা উত্তরোত্তর নামিয়া আসে না, দিন দিন সে সংসার হইতে অপসৃত হইয়া যায় না, যদি না সে তাহার নারীর অবস্থা নামাইয়া আনে। টাহিটির কথা দৃষ্টান্তের মত উল্লেখ করিতেছি। কাপ্তেন কুক তাঁহার ভ্রমণ-কাহিনীতে লিখিয়া গিয়াছেন যে, ইহাদের দাম্পত্য-বন্ধন অতি কদর্য very low, very degraded এমন কি, যে স্ত্রী সুন্দরী, তাহার কিছুতে একটা স্বামীতে মন ওঠে না; বাপের বাড়ির অবস্থা শ্বশুর বাড়ির অবস্থা হইতে ভাল হইলে, স্ত্রী “as a right demand and obtain more husbands” এবং পরবর্তী পর্যটকেরাও এ-সব কথা সত্য করিয়াই স্বীকার করিয়া গিয়াছেন।
কিন্তু এ সমস্ত থাকা সত্ত্বেও ঐ-দেশের পুরুষেরা নারীকে শ্রদ্ধা-সম্মানের চোখে দেখে। বোধ করি এইজন্যই এ-দেশের শিশু-সন্তানেরা অত্যন্ত যত্নের সহিত প্রতিপালিত হয়; এবং সেদিনেও সকলে এ কথাটা একবাক্যে স্বীকার করিয়া গিয়াছিলেন যে, ইহাদের মত শান্ত, সুশীল, অতিথি-বৎসল এবং সৎ অনেক সভ্য-সমাজেও দেখা যায় না। চুরি-ডাকাতি ইহারা জানিত না। সামাজিক অবস্থা তাহাদের অনুকরণীয় এমন কথা বলিতেছি না, কিন্তু তাহারা কোনদিন নারীর অসম্মান করে নাই, অন্যান্য অসভ্যদের মত রমণীর স্থান টানিয়া নীচে নামাইয়া আনে নাই বলিয়াই ১৯০৬ সালে C. L. Wragge ‘The Romance of the South Seas’ গ্রন্থে টাহিটি দ্বীপের অধিবাসীদের সম্বন্ধে উচ্চকণ্ঠে লিখিয়া গিয়াছেন “And what are the duties of women? To look after the house and mind the children; to be good wives, good mothers, to leave politics alone and darn the clothes. Tahitian woman, in woman’s sphere, are superior by far, in my opinion, to their sisters in the Bois and few Belgraviennes can give them points.”
সিলোনের অতি অসভ্য ভেদ্দারা, যাহারা নারীজাতিকে অতিশয় শ্রদ্ধা-সম্মান করে, প্রাণান্তেও এক স্ত্রী বর্তমানে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করে না, এবং কিছুতেই স্ত্রী ত্যাগ করে না, তাহাদের সম্বন্ধে জার্মান বিজ্ঞানাচার্য হেকেল বলিয়া গিয়াছেন, সততা ও ন্যায়পরতায় ইহারা ইউরোপের অনেক সভ্য জাতিকেই শিক্ষা দিতে পারে। ইহাদের অপত্যস্নেহের মত মধুর বস্তু জগতে দুর্লভ। ডায়েক ও টোডাদের সম্বন্ধেও প্রায় এই কথা খাটে। তিব্বতের রমণীদের চরিত্র-বিষয়ে খুব সুনাম নাই। শুধু যে তাহারা সব কয়টি ভাইকেই স্বামীত্বে বরণ করে তাহা নহে, করুণা হইলে পাড়া-প্রতিবেশীর আবেদেন-নিবেদনও অগ্রাহ্য করে না। তথাপি দেশের পুরুষেরা তাহাদের নারীকে অত্যন্ত সম্মান করে। বোধ করি এইজন্যই রাজা রামমোহন রায় এই তিব্বতী রমণীদের সম্বন্ধে বলিয়া গিয়াছেন, “বিপদের দিনে এই তিব্বতের রমণীর দয়াতেই প্রাণ যায় নাই এবং আজিও চল্লিশ বৎসর পরে সেই রমণীগণের কথা স্মরণ করিলে চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হয়”; এবং ইহাদের কাছেই তিনি সারাজীবন ধরিয়া নারীজাতিকে শ্রদ্ধা এবং সম্মান করিতে শিখিয়াছিলেন, এ কথা তিনি নিজের মুখেই স্বীকার করিয়া গিয়াছেন।