সে যাই হউক, আমি এতক্ষণ যাহা বলিয়া আসিয়াছি, তাহা এই যে, প্রায় কোন দেশেই পুরুষ নারীর যথার্থ মূল্য দেয় নাই; এবং তাহাকে নির্যাতন করিয়াই আসিতেছে। নির্যাতন করিয়া যে আসিতেছে, সে কথা অস্বীকার করিবার পথ নাই, কিন্তু ন্যায্য মূল্য হইতে যে চিরদিন বঞ্চিত করিয়াই আসিতেছে, এই কথাটার উপরেই তর্ক বাধিতে পারে। কারণ, কি তাহার সত্য মূল্য তাহা স্থির না করার পূর্বে বলা চলে না নারী যথার্থ মূল্য পাইয়াছে কিনা! পুরুষ এমন কথাও বলিতে পারে যে, যেদেশে নারী যে মূল্য লাভ করিয়া আসিতেছে, হয়ত, সেই দেশে সেই তাহার প্রাপ্য মূল্য। অতএব, এই কথাটা আলোচনা করা আবশ্যক। করিতে হইলে সর্বাগ্রে নর-নারীর সম্বন্ধের বিচারই করিতে হয়। সম্বন্ধ মুখ্যতঃ চারিটা : স্ত্রী, ভগিনী, কন্যা ও জননী—তাহাই আমি পর্যায়ক্রমে আলোচনা করিতেছি। আদিম মানব কি করিয়া স্ত্রী লাভ করিত, তাহার অনেক তথ্য John F. M’Lennan তাঁহার প্রসিদ্ধ Primitive Marriage গ্রন্থে নানা দেশ হইতে আহরণ করিয়া লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। মানুষ যখন পশুর মত ছিল, তখন কি করিয়া স্ত্রী লাভ করিত, আমিও এই প্রবন্ধের প্রারম্ভেই সে ইঙ্গিত একাধিকবার করিয়াছি। সবল দুর্বলের নিকট হইতে কাড়িয়া লইত এবং শখ মিটিলে ত্যাগ করিত; তাহার শখের কাছে, তাহার স্ত্রী-লাভের প্রয়োজনের কাছে সে কিছুই বিচার করিত না, কোন সম্বন্ধই তাহাকে বাধা দিতে পারিত না।M’Lennan একস্থানে বলিয়াছেন, “men must originally have been free of any prejudice against marriage between relations.” তাঁহার এ কথাটা বড় সত্য কথা। Primitive instinct বলিয়া তখন কোন বস্তু ছিল না। মা মেয়ে ভগিনী কিছুই না মানিবার অনেক উদাহরণ শুধু যে অসভ্য আদিম মানবের কাছেই পাওয়া যায় তাহা নহে, অর্ধ-সভ্য ও সুসভ্যের মধ্যেও পাওয়া যায়। অতিশয় সভ্য সমাজেও যে মাঝে মাঝে বীভৎস গোপন কলঙ্কের কথা শোনা যায়, এ-ও যে সেই আদিম মানবের খেলা, তাহা heredity সম্বন্ধে যে-কেহ কিছু আলোচনা করিয়াছেন, তিনিই অবগত আছেন।
পূর্বে বলিয়াছি, অসভ্য চিপিওয়েনরা জননীকে বিবাহ করে। অর্ধ-সভ্য আফ্রিকার গেবুন (Gaboon) প্রদেশের রানী কিছুদিন পূর্বে স্বামীর মৃত্যুর পর রাজ্য হারাইবার আশঙ্কায় নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্রকে বিবাহ করিয়া সিংহাসনের দাবী বজায় রাখিয়াছিলেন। পারস্যের সম্রাট আর্টজারাক্সস্ নিজের রূপবতী দুই কন্যারই পানিগ্রহণ করিয়াছিলেন। সুসভ্য প্রাচীন মিশরের ফারাওরা সহোদরাকে বিবাহ করিতেন। সভ্য পেরু প্রদেশের রোক্কা ইঙ্কার বংশধর ষষ্ঠ কিংবা সপ্তম ইঙ্কা আভিজাত্য বজায় রাখিবার জন্য দ্বিতীয় পুত্রের সহিত কনিষ্ঠ কন্যার বিবাহ দিয়া সিংহাসনে বসাইয়াছিলেন। বশিষ্ঠ ঋষিও তাঁহার ভগিনী অরুন্ধতীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। লঙ্কা-দ্বীপের অসভ্য ভেদ্দারা ছোট বোনকে বিবাহ করা সবচেয়ে গৌরবের ব্যাপার বলিয়া মনে করে। সমাজে কুলীন বলিয়া তখন তাহার মান বাড়ে। বৈমাত্র ভগিনী ও বিধবা ভ্রাতৃবধূকে বিবাহ করা ত প্রায় সব দেশেই প্রচলিত আছে। অথচ ইহাদের কেহই এক অসভ্য ভেদ্দা ছাড়া একটিমাত্র স্ত্রী লইয়া সন্তুষ্ট থাকে না। সকলেই বহুবিবাহ করে। অর্থাৎ, মানুষ ঘরেরটাও পরকে দেয় না এবং পরেরটাও কাড়িয়া আনে। এখানে যদি মনে করা যায়, উপরে যে সব কথা বলা হইল, তাহা শুধু ওই-সব দেশ ও জাতির সম্বন্ধে খাটে, অন্যান্য দেশে খাটে না, তাহা হইলে ভুল বুঝা হইবে। সব দেশে এবং সব জাতির সম্বন্ধেই যে ওই কথা খাটে, কোথাও ও-প্রথা লুপ্ত হইয়াছে, কোথাও আজিও প্রচলিত আছে। আমাদের এ-দেশে আজ বড় ভাই ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর ছায়া পর্যন্ত স্পর্শ করিতে পারে না, কিন্তু এই দেশের পাণ্ডবেরা পাঁচ ভাই এক দ্রৌপদীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। এবং ঠিক স্মরণ হইতেছে না, দীর্ঘতপা ঋষিরাও সাত ভাই বুঝি এক স্ত্রী লইয়াই ঋষিযাত্রা নির্বাহ করিয়াছিলেন। এবং ইহাকেই মহাভারতের আদিপর্বে সনাতন প্রথা বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। এবং যাহাকে অসভ্যদিগের ‘marriage by capture’ বলা হয়, তাহার যে বহুল প্রচলন এই সভ্য ভারতভূমেও ছিল, সে দৃষ্টান্তেরও অসদ্ভাব নাই। নারী লইয়া এই যে ঘরে-বাহিরে টানাটানি, কাড়াকাড়ি, অথচ দুইদিন পরে তাহার কোন দাম নাই—এইটা বুঝাইবার জন্যই নারীর আদিম অবস্থার ইঙ্গিত করিয়াছি। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আবিসিনিয়ার লোকেরা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হইলে সর্দারকে নিজের মাথার পরিবর্তে যুবতী কন্যা কিংবা স্ত্রী দান করিত, এই মূল্যবান উপহার আবার সর্দার দু’দিন পরে যাহাকে ইচ্ছা বিলাইয়া দিতেন।
Captain Speke এই দেশের রাজার সম্বন্ধে একটা দিনের ঘটনা বিবৃত করিয়াছেন—“next the whole party (King and Queens) took a walk winding through the trees and picking fruit, enjoying themselves amazingly, by some unlucky chance, one of the royal wives, a most charming creature and truly one of the best of the lot plucked a fruit and offered it to the king, thinking doubtless to please him greatly, but he, like a mad man flew into a towering passion, said it was the first a woman ever had the imprudence to offer him anything and ordered the pages to seize, bind and lead her off to execution”. তাঁহার পরে স্পিক লিখিতেছেন,—“it was too much for my English blood to stand; and of course I ran imminent risk of losing my own in trying to thwart the capricious tyrant but I saved the woman’s life.” নারী লইয়া পুরুষের এই যে পুতুল-খেলা, এই যে স্বার্থপরতা, পাশব বৃত্তির এই যে একান্ত উন্মত্ততা, সে শুধু নারীজাতিকেই অপমানিত ও অবনমিত করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, পুরুষ যে, সমাজকে এবং সমস্ত মাতৃভূমিকে ঐ সঙ্গে টানিয়া নামাইয়া আনিয়াছে। বিভিন্ন দেশের নজীর দিয়া দেখাইবার স্থান এ প্রবন্ধে নাই, তাই আমি শুধু কাপ্তেন স্পিকের আর একটা কথা বলিয়াই থামিব। তিনি বলিয়াছেন, আফ্রিকার এতবড় দুর্দশার বারো-আনা হেতু পুরুষের এই উচ্ছৃঙ্খলতা। তথায় সর্দারদিগের এবং ক্ষমতাসম্পন্ন লোকদিগের মৃত্যুর পরেই একটা যুদ্ধ-বিগ্রহ ওলটপালট অনিবার্য। সেখানে, কে যে কার বৈমাত্র ভাই হয়, কাহার সম্পত্তিতে কাহার যে অধিকার নাই, তাহা গায়ের জোর এবং বল্লমের ফলা ভিন্ন প্রতিপন্ন করার দ্বিতীয় পথ নাই। আরো একটা কথা। ঐ কাপ্তেন সাহেব যখন তাঁহার একজন ওয়াবিম্বি নিগ্রো ভৃত্যের মুখে শুনিলেন যে, তাহারা নরমাংস আহার করে এবং বড় ভালবাসে তখন প্রশ্ন করিয়াছিলেন, “বাপু, নরমাংস এত পাও কোথায়? নিজেদের লোক মারিয়া আহার কর কি?” সে লোকটা জবাব দিয়াছিল, “না, নিজেদের লোক মারি না, আশপাশের গাঁ হইতে কিনিয়া আনি।” “অর্থাৎ?” লোকটা বলিল, “যে সব ছেলেমেয়েদের বাপ নাই, তাহারা খাইতে না পাইয়া প্রায়ই পীড়িত হইয়া পড়ে, তখন তাহাদের জননীরা একটা ছাগল পাইলেই শিশুগুলিকে দিয়া দেয়, আমরা ঘরে আনিয়া মারিয়া খাই।” সুসভ্য দেশেও বাপ আর একটা বিবাহ করিয়া তাহার দ্বিতীয় পক্ষের শিশুগুলির তুলনায় প্রথম পক্ষের সন্তানগুলির উপরে যেমন অনেক সময়েই নির্দয় হইয়া উঠেন, এ-ক্ষেত্রে জননীরাও বোধ করি সেইরূপই হয়, তবে অসভ্য বলিয়া কিছু বাড়াবাড়ি করে এবং করাই বোধ করি স্বাভাবিক! আন্দামান দ্বীপের অসভ্যদিগের একটা প্রথা আছে, শিশুর দাঁত না-ওঠা পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে থাকে, তার পর যে যাহার পথ দেখে। পুরুষটি আর একটি স্ত্রী খোঁজে, তাহার স্ত্রীটিও তাই। সে সময়ে জননীরা প্রায়ই তাহাদের দাঁত-ওঠা শিশুটিকে কোন একটা জলাশয়ের ধারে ফেলিয়া দিয়া দ্বিতীয় সংসার করিতে যায়।