এইখানে একটা প্রশ্ন মনে উঠে; সংসারে মানবজাতির কোন্ অবস্থায় নারীর উপর প্রথম নির্যাতন শুরু হইয়াছিল? মানুষ যখন পশুর মত ছিল,—তখন হইতে, না কতক মানুষের মত হইবার পর হইতে? এ সম্বন্ধে কোন সমাজতত্ত্ববিদই ঠিক কিছু বলিতে পারেন না। পারিবার কথাও নয়। কারণ প্রত্যেক জাতির মধ্যেই, তিনি সুসভ্যই হউন, আর অসভ্যই হউন, নর-নারীর সম্বন্ধটা এতই জটিল, এতই রহস্যে ঢাকা যে, বাহিরের লোকের বাহির হইতে দেখিয়া কিছুতেই তাহা ঠিক করিয়া বলিবার জো নাই। লেটুর যখন প্রথম প্রচার করিয়াছিলেন, পৃথিবীর সমস্ত অসভ্যেরাই নারীজাতিকে যৎপরোনাস্তি যন্ত্রণা দেয়, তখন তিনি নিজের বুদ্ধির উপর নির্ভর করিয়াই বলিয়াছিলেন, এবং তখন অনেকেই সে কথা বিশ্বাস করিয়াছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি অনেক পণ্ডিতই তাহাতে ধীরে ধীরে আস্থাশূন্য হইয়া পড়িতেছেন। বস্তুতঃ, নর-নারীর সম্বন্ধটা কিছুতেই এমন হইতে পারে না যাহাতে “extreme and unmitigated oppression constantly subjected to unimaginable cruelty and violence by the savage”. খাঁটি সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিতে পারা যায়। এমন হইলে সংসারে মানবজাতিই লোপ পাইত। এই সত্যটা সমস্ত আলোচনার মধ্যে মনে করিয়া না রাখিলেই ভুল হইবে। তবে তাঁহারও কথাটা যে বারো-আনা সত্য, তাহাতে সন্দেহ নাই। উপরন্তু Haddon সাহেব যে জোর করিয়া তাঁহার Head Hunters গ্রন্থে বলিয়াছেন, ‘by no means down-trodden or ill-used,’ সে কথাটাও নিতান্ত অশ্রদ্ধেয়। যদিও তাঁহার এই কথাটার অনুকূলে কয়েকটা অসভ্য জাতির মধ্যে দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, যথা, ভারতের খাসিয়া রমণীরা বিরক্ত হইলে স্বামীকে গৃহ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দেয়। নিকারাগুয়া ও টাহিটির স্ত্রীলোকেরাও স্বামীকে তাড়াইয়া দিয়া পুনরায় বিবাহ করে। আপাচ জাতিরা লড়াইয়ে হারিয়া আসিলে স্ত্রীরা স্বামীদের ঘরে ঢুকিতে দেয় না।
রেভারেন্ড সুটার সাহেব বলেন, নারীর অনেকটা মান-মর্যাদা আফ্রিকার কঙ্গো এবং উগান্ডা প্রদেশে আছে। বস্তুতঃ সেদেশে রমণী রানী পর্যন্ত হয়। অথচ Captain Speke তাঁহার Discovery of the Source of the Nile গ্রন্থে কঙ্গো ও উগান্ডা দেশের ওয়াহুমা বড় লোকেরা কি করিয়া কথায় কথায় প্রায় বিনা অপরাধে স্ত্রী-হত্যা করে, নিজের হাতে আঁকিয়া তাহার ছবি পর্যন্ত দিয়া গিয়াছেন; ঐ গ্রন্থে লিখিয়াছেন, হাতে দড়ি বাঁধিয়া স্ত্রীগুলিকে বধ্যভূমিতে টানিয়া লইয়া যাইবার সময় তাহারা যেভাবে উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে কাঁদিতে যায়, শুনিলে অতি-বড় পিশাচেরও দয়া হয়, অথচ সেদেশের পুরুষগুলি তাহাতে ভ্রুক্ষেপ করে না। গ্রন্থকারের তাঁবুর পার্শ্বের পথের উপর দিয়া তাই প্রায়ই বামাকণ্ঠে কান্না উঠিত—“হে মিয়াঙ্গি, হে বাক্কা!” “ও আমার স্বামী! ও আমার রাজা!” স্বামী এবং রাজাটি বোধ করি তখন মৃদু-মধুর হাস্য করিতেন। সেই দেশের রাজা কিনেরার মৃত্যুর অব্যবহিত পরের ঘটনাগুলি যাহা কাপ্তেন স্পিক তাঁহার পুস্তকে চোখে দেখিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন, তাহা পাঠ করিলে মনে হয়, শিশুরা মাটির পুতুলের যে মূল্য দেয় সে মূল্যও তথাকার পুরুষেরা নারীকে দেয় না। একস্থানে লেখা আছে, মৃত পিতার সমস্ত কন্যাগুলিকেই ছোট রাজা বিবাহ করিলেন, এবং সাতদিন পরে তাহার তিনটিকে ঠিকমত ঙাজিগ (সেলাম) না করার অপরাধে জীবন্ত দগ্ধ করিলেন। প্রায় পর্যটকই পৃথিবীর আদিম অধিবাসীদের সম্বন্ধে লিখিয়া গিয়াছেন যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটা ভালবাসার ব্যাপার অধিকাংশ অসভ্য জাতিরাই অবগত নহে। মন্টেরো বলেন, “The Negro knows not love, affection or jealousy, they have no words or expression in their language indicative of affection or love”. স্যর জন লবক ঐ দেশেরই সম্বন্ধে বলেন, “are so cold and indifferent to one another that you would think there was no such thing as love between them”. কাফ্রিদের সম্বন্ধে ‘no feeling of love in marriage’. জারিবদের সম্বন্ধে ‘affection between man and wife out of the question’. অথচ ইহাদিগের মধ্যেই নারীর পতিপ্রেম, স্বামী-সেবার কথা শোনা যায় না, তাহা নহে। হইতে পারে জবরদস্তির চোটে, সে যাই হোক, অতিশয় নিষ্ঠুর ডাহোমান, মালগাসি, ফিজিয়ান, ছিপা, বেচয়ানা, ইহাদের সকলের ঘরেই পতিব্রতা স্ত্রী পাওয়া যায়। ডাহোমি ও ফিজি-দ্বীপে স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবারা আত্মহত্যা করে, তাহা পূর্বেই বলিয়াছি। আমেরিকান মন্ডান জাতির বিধবারা মৃত স্বামীর কপাল সংগ্রহ করিয়া আনিয়া গলায় মালা করিয়া গাঁথিয়া রাখে, রাত্রে মুণ্ডটাকে বিছানায় লইয়া শয়ন করে, স্নান করাইয়া দেয়, আহার করায়, শীতের দিনে কাঁথা চাপা দিয়া রাখে, এমন কি গান গাহিয়াও তাহাকে ঘুম পাড়ায়। অথচ, পুরুষেরা জীবিতাবস্থায় কি কীর্তিই না করিয়া যান! তবে এমন কথাও বলিতেছি না যে, সর্বত্রই পুরুষেরা ক্রমাগত অত্যাচার করিয়াই চলে, এবং তৎপরিবর্তে রমণীরা কেবল ভালবাসিতে, সেবা করিতেই থাকে।
এমন কথা বলিলে মানবের স্বভাবের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়; তবে কোন কোন স্থানে দারুণ অত্যাচার-অবিচারের পরিবর্তেও যদি স্নেহ-প্রেম সম্ভবপর হয়, তাহা রমণীতেই হয়, এবং সে দৃষ্টান্ত অনুসন্ধান করিলে নির্মম অসভ্য মানব-সমাজেও যে দুর্লভ নয়, তাহাই গোটা-দুই দৃষ্টান্ত দিয়া দেখাইলাম মাত্র। নারীর এই মূল্য পুরুষ স্বীকার করিতে চাহে না এবং করে না, তাহা বহুবিধ প্রকারেই বলিবার চেষ্টা করিয়াছি। অবশ্য ইহার প্রতিকূলেও কিছু বলিবার আছে, কিন্তু তৎসত্ত্বেও এ কথা সত্য যে, তাহা অঙ্গীকার করিয়া লইলেও এ প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য তিলার্ধও বিচলিত হয় না।