মানুষ যখন মানুষ হইয়া উঠে নাই, তাহার পূর্বেও সে যে কার্য-কারণের অবিচ্ছিন্ন সম্বন্ধের আভাস পাইয়াছিল, আজকাল পণ্ডিতেরা তাহা আর অস্বীকার করেন না। সে যখন শামুক ছিল, তখনই অকস্মাৎ মেঘের ছায়ায় সূর্যের আলো মলিন দেখিয়া ভয়ে মুখ বুজিয়া আত্মরক্ষার চেষ্টা করিয়াছিল,—সে টের পাইয়াছিল ছায়া শুধু ছায়া নয়, তার সঙ্গে আর কিছু একটা আসিতেছে। যে আসিতেছে সে প্রবল, সে সন্নিকটবর্তী, হয়ত অপকার করিবে এই তার ভয়। ছায়ার কারণ দেখিয়া সে কার্য অনুমান করিয়াই দুর্গদ্বার আঁটিয়া বদ্ধ করিয়া দিয়াছিল।
সেই জীবের ক্রমোন্নতি-ব্যাপার জগতে সত্য বলিয়া স্বীকৃত হইবার পরে মনস্তত্ত্ব-সম্বন্ধীয় যতগুলি পুস্তক বাহির হইয়াছে, তাহাতে এই একটা কথা পুনঃ পুনঃ আলোচিত হইয়াছে যে, মানুষের বুদ্ধি ও প্রবৃত্তি ঠিক তাহার শরীরের মতই ধীরে ধীরে উন্নত হইয়াছে। সুতরাং সাধারণ পশু অপেক্ষা যদিচ এ-সব বিষয়ে মানুষ খুবই বড় হইয়াছে, তবুও একটা সম্পর্কের টান যে রহিয়াই গিয়াছে তাহাকে কোনমতেই না করিবার পথ নাই। এই পার্থক্য পরিমাণগত, প্রকৃতিগত নহে। সেই সত্যটা বুঝিয়া লইয়া যদি সন্ধান করা যায়, যাহাকে আমরা পশু বলি, তাহাদের মধ্যে নারীর মূল্য আছে কি না? দেখা যায় আছে। দুটো সিংহ প্রাণান্তকর যুদ্ধ করিতে থাকে, সিংহীটা চুপ করিয়া লড়াই দেখে। যে জয়ী হয়, ধীরে ধীরে তাহার সহিত প্রস্থান করে, একবার ফিরিয়াও চাহে না অপরটা মরিল কি বাঁচিল। অতঃপর এই সিংহমিথুন কিছুকাল একসঙ্গে বাস করে, তার পর সিংহী যখন আসন্নপ্রসবা তখন ইহারা পৃথক হয়—সন্তান লালন-পালন ও রক্ষা করার ভার একা জননীর উপরই পড়ে। সিংহ মহাশয় সন্তানের কোন দায়িত্বই গ্রহণ করেন না, বরঞ্চ সুবিধা পাইলে সংহার করিবার চেষ্টাতে ফিরিতে থাকেন। বাঁদর ও গোরিলার মধ্যেও প্রায় অনুরূপ প্রথা দেখা যায়। ইহাতে লাভ এই হয় যে, এমন জাতি ধ্বংসের মুখেই অগ্রসর হইতে থাকে। ইতিমধ্যে অনুকূল কারণ না থাকিলে, গহন বনে বা অতি নিভৃত পর্বত-কন্দরে সন্ততি-রক্ষার আশ্রয় না মিলিলে আমরা বোধ করি এই পশুগুলোর নাম পর্যন্ত জানিতে পারিতাম না। তাহারা বহু পূর্বেই নিঃশেষ হইয়া যাইত। এই ঘটনাটা একটু প্রণিধান করিয়া দেখিলেই একটা আশ্চর্য আত্মঘাতী ব্যাপার চোখে পড়ে। এই পশু বংশবৃদ্ধির নৈসর্গিক তৃষ্ণা ও উত্তেজনার বশে লড়াই করিয়া প্রাণ দেয়, অথচ ইহারই শেষ সফলতার দিকে একবার ফিরিয়াও দেখে না। তা ছাড়া আরো একটা কথা এই, যে জন্তুটা প্রাণ দেয়, সে নিজের অসহ্য প্রবৃত্তির যূপকাষ্ঠেই কণ্ঠচ্ছেদ করে, নারীর জন্য নারীর পদমূলে আত্মবিসর্জন করে না। অতএব মূল্য যদি এখানে কিছু থাকে ত সে তাহার নিজের প্রবৃত্তির, নারীর নয়। এই দুটো কথা মনে রাখিয়া পশুর রাজ্য অতিক্রম করিয়া মানুষের রাজ্যে পদার্পণ করিয়াও এই ব্যাপারের অসদ্ভাব ঘটে না, এবং আজ এই পাশব প্রবৃত্তিকে নিজেদের সমাজে যত ইচ্ছা বড় বলা হউক না কেন, এবং নর-নারীর স্বর্গীয় প্রেমের জন্মভূমি যতবড় স্বর্গেই নির্দেশ করা থাক না কেন, তাহা সত্য নয়, নিছক কল্পনা মাত্র। আমি গোটা-দুই দৃষ্টান্ত দিয়া তাহাই বলিতেছি। কিন্তু বলিবার পূর্বে এ কথাটাও বিশেষ করিয়া বলিয়া রাখি যে, ক্রমোন্নতির ফলে নর-নারী সহস্রমুখী স্নেহ-প্রেমের যে মধুর চিত্র বাল্মীকির হৃদয়ে, ব্যাসের হৃদয়ে, কালিদাসের হৃদয়ে উদ্ভূত হইয়া বিশ্বজগতে প্রতিবিম্বিত হইয়াছে, তাহা স্বর্গীয় বস্তু অপেক্ষা কোন অংশে হীন নয়। নীচকুলে জন্ম বলিয়া আর তাহাকে উপেক্ষা করা যায় না। কোহিনুরকে পাথুরে-কয়লার খোঁটা দিয়া, উপনিষদের ব্রহ্মজ্ঞানকে ভূতের ভয়ের লজ্জা দিয়া তাহার যথার্থ মূল্য হইতে তাহাকে বঞ্চিত করা কিছুতেই চলে না।
এ সকল আমি জানি। এবং জানি বলিয়াই ইহার জন্মের কথা তুলিয়াছি, এবং ধীরে ধীরে এই মূল্য যে আজ যথার্থ কতবড় হইয়া উঠিয়াছে তাহা মানবের আদিমযুগের ইতিহাসের দিকে চাহিয়া পরিমাণ করিতে আহ্বান করিতেছি। কি করিয়া পাশব বৃত্তি অদ্ভুত অনির্বচনীয় প্রেমে, পাতিব্রত্যে রূপান্তরিত হইয়াছে, কি করিয়া নরের প্রবৃত্তির মানদণ্ডে প্রথম পরিমিত নারীর মূল্য একদিন ভাবুকের হৃদয়ে অপরিমেয় দেবতার মূল্যে এক আসন পাতিয়াছে এবং সেই তাহার যথার্থ স্থান কি না, তাহা দেখিতে গেলে সাহসপূর্বক গোড়া হইতে দেখিবার চেষ্টা করা উচিত। চোখ বুজিয়া যাহা অভিরুচি হয় বলিব, যাহা খুশি শাস্ত্র বানাইব, যথা ইচ্ছা দাম দিব, এ শুধু বলবানের গায়ের জোরে করা যায়, সত্যের জোরে, ন্যায়ের জোরে করা যায় না। মূল্যের একটা নৈসর্গিক নিয়ম আছে, সেও যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অদ্বিতীয় ও একমাত্র নিয়মের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত, কৃত্রিম উপায়ে তাহাকে বাড়াইলে কমাইলে শেষ পর্যন্ত যে সুফল ফলে না, সেন-রাজার কৃত্রিম কুলীন-করা বামুনের দাম যে ক্রমাগত বাড়িয়াই চলে নাই, পেরুর ইঙ্কার জোর-করা আভিজাত্য যে তাহাকে ধ্বংস না করিয়া ছাড়ে নাই, এই সত্য যে-কেহ লোক, যে-কোন জাতি, আলস্য অজ্ঞান বা দম্ভের জোরে অস্বীকার করিবে, সে-ই যে কক্ষভ্রষ্ট উপগ্রহের মত অনিবার্য মৃত্যুর পথেই দিন দিন ধাবিত হইবে, তাহাতে আর সংশয়মাত্র নাই।
এই সত্য সুস্পষ্ট উপলব্ধি করা যায়, জগতের আদিম মানবজাতির রীতি-নীতির দিকে চাহিয়া দেখিলে। ইতিপূর্বে আমি মুখ্যতঃ সভ্য-জাতির সম্বন্ধেই আলোচনা করিয়াছি, তাহারা নারীর মূল্য কোথায় ধার্য করিয়াছে, তাহাই নিরুপণ করিবার প্রয়াস করিয়াছি; এইবার দেখিতে চাহি, যে-মানুষ এখনও সুসভ্য হইয়া উঠিতে পারে নাই, তাহারা নারীর মূল্য কি দিয়াছে।