ইহাদের প্রায় সকলেরই হেতু লেখা ছিল, অত্যধিক দারিদ্র ও স্বামী প্রভৃতির অসহনীয় অত্যাচার-উৎপীড়ন। সধবাদিগের প্রায় সবগুলিই নীচজাতীয়া এবং বিধবাদিগের প্রায় সবগুলিই উচ্চজাতীয়া। নীচজাতীয়া সধবারা এই বলিয়া জবাবদিহি করিয়াছিল যে, খাইতে-পরিতে তাহারা পাইত না,—দিনে উপবাস করিত, রাত্রে স্বামীর মারধর খাইত। সৎ-কুলের বিধবারাও কৈফিয়ত দিয়াছিল—কেহ-বা ভাই ও ভ্রাতৃজায়ার, কেহ-বা শ্বশুর-ভাসুরের অত্যাচার আর সহ্য করিতে না পারিয়া এই কাজ করিয়াছে। ইহাদের সকল কথাই যে সত্য তাহা নয়, তথাপি সমস্ত ব্যাপারটা একটু মনোযোগের সহিত দেখিলেই চোখে পড়ে,—এমনিই বটে!
ভদ্রকুলের বিধবারা স্বামীর অবর্তমানে যেমন নিরুপায়, নীচজাতীয়া সধবারা স্বামীর বর্তমানে ঠিক তেমনি নিরুপায়। কিন্তু, তাহাদের বিধবার অবস্থা ভাল। কারণ, নীচ-ঘরের স্ত্রীলোকেরা বিধবা হইলে আর বড় কাহাকেও মিথ্যা ভয় করিয়া চলে না,—অনেকটা স্বাধীন। তাহারা হাটে-বাজারে যায়, পরিশ্রম করে, ধান ভানে, প্রয়োজন হইলে দাসীবৃত্তি করে। সুতরাং সৎ উপায়ে জীবিকানির্বাহ করা তাহাদের পক্ষে সহজ,—তাহারা তাই করে, কুলত্যাগ করিবার আবশ্যক হয় না, করেও না—। অথচ, তাহাদের সধবার পক্ষে সে পথ বন্ধ। স্বামী বিদ্যমানে, সে না পায় দুঃখ-মেহন্নত করিতে, না পায় খাইতে-পরিতে। স্বামী ভাতকাপড় যোগাইতে পারে না, যাহা পারে তাহা শুধু মারধর করিয়া শাসন করিতে। ঐ যে কথা আছে, “ভাতকাপড়ের কেউ নয়, কিল মারবার গোঁসাই।” কথাটা বাঙলার নিম্নশ্রেণীর মধ্যে যে কতদূর সত্য, এবং কতবড় দুঃখেই যে ছড়াটার সৃষ্টি হইয়াছিল, তাহা লিখিয়া শেষ করা যায় না। আবার ভদ্র-ঘরের বিধবার অবস্থা ঠিক নীচজাতীয়া সধবার অনুরূপ। তাহাকেও স্বাধীনভাবে কায়িক পরিশ্রম করিয়া জীবিকা অর্জন করিতে দেওয়া হয় না, কারণ তাহাতে পিতৃকুলের বা শ্বশুরকুলের মর্যাদা হানি হয়, অথচ বাড়ির মধ্যে ভদ্র-বিধবার অবস্থা কাহারো অবিদিত নাই। আমিও ইতিপূর্বে তাহা একাধিকবার বলিয়াছি। অতএব দেখিতে পাওয়া যায়, শতকরা সত্তর জন হতভাগিনী অন্ন-বস্ত্রের অভাবে এবং আত্মীয়-স্বজনের অনাদর, উপেক্ষা, উৎপীড়নেই গৃহত্যাগ করে, কামের পীড়নে করে না। এবং এই জন্যই কুলত্যাগিনীদের মধ্যে বিধবা অপেক্ষা সধবার সংখ্যাই অধিক। অথচ, কিছুমাত্র অনুসন্ধান না করিয়াই পুরুষ ধরিয়া লইয়াছে, কুলত্যাগ শুধু বিধবাতেই করে, অতএব অদ্ভুত বিধিনিষেধের দ্বারা তাহাকে শাসন করাই ঠিক কাজ। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে কুলত্যাগ যে পতিযুক্তারাই অধিক করে, এবং তাহা পুরুষেরই অত্যাচার-উৎপীড়নের ফলে, এ কথা কোন্ পুরুষ স্বীকার করিতে সম্মত হইবে? এদিকে পুরুষ যেমন দরিদ্র ও কহনাতীত উৎপীড়নে নারীর স্বাভাবিক শুভবুদ্ধিকে বিকৃত করিয়া দিয়া ঘরের মধ্যে তাহাকে অতিষ্ঠ করিয়া তোলে, অন্যদিকে তেমনি তাহাকেই আপাতমধুর সুখের প্রলোভনে প্রতারিত করিয়া ঘরের বাহির করিয়া আনে।
পুরুষের ভয় নাই, সে যদিচ্ছা সুখ ভোগ করিয়া ফিরিয়া যাইতে পারে। তাই সে ফিরিয়া গিয়া দিন-দুই ঘরের কোণে অনুতপ্তভাবে বসিয়া থাকে, আত্মীয়স্বজন তাহার পুনরাগমনে খুশী হইয়া সাহস দিয়া বলিতে থাকে, “তার আর কি? ও অমন হইয়া থাকে,—পুরুষের দোষ নেই। এস বাহিরে এস।” সেও তখন হাসিমুখে বাহির হয় এবং গলা বড় করিয়া প্রচার করিতে থাকে, নারীর পদস্খলন কিছুতেই মার্জনা করা যাইতে পারে না।
ঠিক ত! যে কারণেই হউক, যে নারী একটিবার মাত্রও ভুল করিয়াছে, হিন্দু তাহার সহিত কোন সংস্রব রাখে না। ক্রমশঃ, ভুল যখন তাহার জীবনে পাপে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়, দিন দিন করিয়া যখন তাহার সমস্ত নারীত্ব নিঙড়াইয়া বাহির হইয়া যায়—যখন বেশ্যা—তখন, আবার তাহার অভাবে হিন্দুর স্বর্গও সর্বাঙ্গসুন্দর হয় না। এতই তাহার প্রয়োজন। দেশের লোক আদর করিয়া যেমন শ্রীকৃষ্ণের ‘কালো সোনা’, ‘কালো মাণিক’ প্রভৃতি অষ্টোত্তর-শতনাম দিয়াছিল, সংস্কৃত-সাহিত্যেও বোধ করি বেশ্যার আদরের নাম তার চেয়ে কম নয়। এই-সকল হইতেই বুঝিতে পারা যায়, স্বার্থপরতা ও চরিত্রগত পাপবৃদ্ধি নর-নারী কাহার অধিক। এবং, সমাজ হইতে এই পাপ বহিষ্কৃত করিতে হইলে শাস্ত্রের কড়া আইন-কানুন কাহার সম্বন্ধে অধিক থাকা উচিত, এবং সামাজিক জীবন বিশুদ্ধ রাখা উদ্দেশ্য হইলে নর-নারীর কাহাকে অধিক চোখে চোখে রাখা কর্তব্য, এবং শাস্তি কাহাকে অধিক দেওয়া আবশ্যক। অথচ, সমাজ নারীর ভুল-ভ্রান্তি এক পাইও ক্ষমা করিবে না, পুরুষের ষোলআনাই ক্ষমা করিবে। হেতু? হেতু শুধু গায়ের জোর। হেতু শুধু সমাজ অর্থে ‘পুরুষ’, ‘নারী’, নয় বলিয়া। কাজটা ঘৃণার কাজ, তাই পুরুষ নারীকে ঘৃণা করে। তাহাকে ঘৃণা করিবার অধিকার দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু নারীকে সে অধিকার দেওয়া হয় নাই। পুরুষ যতই ঘৃণ্য হউক, সে স্বামী! স্বামীকে ঘৃণা করিবে স্ত্রী কি করিয়া? শাস্ত্র যে বলিতেছেন, তিনি যেমনই হউন না, সতী স্ত্রীর তিনি দেবতা। এবং, এই দেবতাটির মৃত্যু ঘটিলে তাঁহার পদপঙ্কজ ক্রোড়ে করিয়া অনুগমন করা আবশ্যক। অন্ততঃ এ যুগে তাঁহারই পদপঙ্কজ স্মরণ করিয়া জীবন্মৃত হইয়া থাকাতেই যথার্থ নারীত্ব।
কেহ কেহ বৈজ্ঞানিক তর্কের অবতারণা করিয়া বলেন, ভবিষ্যৎ বংশধরের ভালো-মন্দ লক্ষ্য করিয়া দেখিলে নারীর ভুল-ভ্রান্তিতেই ক্ষতি হয়, পুরুষের হয় না। অথচ চিকিৎসকেরাই বিদিত আছেন, কত কুলস্ত্রীকেই না অসতীর পাপ ও কুৎসিত ব্যাধিযন্ত্রণা ভোগ করিতে হয়, এবং কত শিশুকেই না চিররুগ্ন হইয়া জন্মগ্রহণ করিতে হয়, এবং সারাজীবন ধরিয়া পিতৃ-পিতামহের দুষ্কর্মের প্রায়শ্চিত্ত করিতে থাকে। অথচ, শাস্ত্র এ সম্বন্ধে অস্পষ্ট, লোকাচার নির্বাক্, সমাজ মৌন। তাহার প্রধান কারণ এই যে, শাস্ত্রবাক্যগুলা সমস্তই প্রায় ফাঁকা আওয়াজ। পুরুষের ইচ্ছা এবং অভিরুচিই আসল কথা এবং তাহাই সমাজের যথার্থ সুনীতি।