কোন কোন ক্ষেত্রে মায়া-মমতা হয়ত বাধা দিতেও আসে, কিন্তু তখন আর উপায় থাকে না। স্বার্থের জন্য পুরুষ সাধারণভাবে একবার যে-প্রথাকে ধর্মের অনুশাসন বলিয়া প্রতিষ্ঠা করে, পিতা হইয়া আর সেই প্রথাকে নিজের সন্তানের বেলা অতিক্রম করিতে পারে না।
পঞ্চাশ বৎসরের বৃদ্ধের সহিত যখন তাহাকে বালিকা কন্যার বিবাহ দিতে হয়, হয়ত তাহার ক্ষণকালের জন্য বুকে বাজে, কিন্তু উপায়ও সে খুঁজিয়া পায় না। তাহাকে জাত বাঁচাইতে হইবে। ধর্মরক্ষা করিতে হইবে। যে প্রথা, সে পুরুষ হইয়া, সমাজের একজন হইয়া, নিজের হাতে গড়িয়াছে, এখন সেই প্রথা তাহাকে এক হাতে চোখ মুছায়, আর এক হাতে সম্প্রদান করিতে বাধ্য করে। স্নেহের এত বড় জোর নাই যে, তাহাকে এই নির্দয় কর্ম হইতে বিরত করিতে পারে! সুতরাং দেখা যায়, স্নেহ-মায়া-দয়া থাকা সত্ত্বেও লোকে অমঙ্গল করিতে পারে, এবং পরম আত্মীয় হইয়াও পরম শত্রুর মতই ক্লেশ দিতে পারে। আজ সে স্বার্থের কথা মনে করিতে পারিবে না জানি, এখন সে ধর্মের দোহাই পাড়িয়াই আপনাকে শান্ত করিবে, কিন্তু কোথায় ইহার সুদূর মূল নিহিত আছে, ইহা যদি সে তলাইয়া দেখিতে চাহে, সেখানে অখণ্ড স্বার্থপরতা ভিন্ন আর কিছুই সে দেখিতে পাইবে না। কিন্তু এ দেখা কঠিন। পিতার পক্ষেও কঠিন, তাহার কন্যার পক্ষেও কঠিন। প্রতিষ্ঠিত নিয়ম পালনের মধ্যে মানুষ যখন একান্ত মগ্ন হইয়া থাকে, চোখের দৃষ্টিও তখন তাহার রুদ্ধ হইয়া যায়। সে কোনমতেই দেখিতে পায় না, কোন্টা ধর্ম, কোন্টা অধর্ম! বৈদিক যজ্ঞের অগণিত পশুহত্যার মধ্যে কোথায় অন্যায় ছিল, মানুষ তখনই শুধু দেখিতে পাইয়াছে, বুদ্ধদেব যখন তাহাকে পৃথক করিয়া লইয়া গিয়াছেন। সহমরণ আজ রহিত হইয়া গিয়াছে, তাই আজ সে কথা মনে করিয়া শিহরিয়া উঠি। গঙ্গাসাগরে সন্তান নিক্ষেপ করার মধ্যে কত পাপ গোপন ছিল, আজ তাহা দেখিতে পাইয়া ইংরাজের আইনকে সর্বান্তকরণে আশীর্বাদ করি। অথচ সে সময় কত না লড়াই করিয়াছি! গাঁটের পয়সা অপব্যয় করিয়া বিলাত পর্যন্ত আপীল করিয়াছি! যাহারা প্রধান উদ্যোগী হইয়াছিল, আপীল করিতে, বাধা দিতে সাহায্য করিয়াছিল, তাহাদিগকে পরম মিত্র বলিয়া আহ্বান করিয়াছি, স্বর্গীয় রামমোহনকে ধর্মদ্বেষী রাক্ষস বলিয়া গালিগালাজ দিয়াছি। আজ সে ভ্রম বোধ করি ধরা পড়িয়াছে,—তথাপি চৈতন্য হয় নাই। আজও সামাজিক প্রশ্নের মীমাংসা খুঁজিতে টোলের ভট্চার্যির নিকট ছুটিয়া যাই। কোন্টা ভাল, কোন্টা মন্দ, তাহাদিগকে গিয়া প্রশ্ন করি। কারণ, তাহারা শাস্ত্রবিৎ। কিন্তু এ কথাটা একবারো ভাবি না, তাহারা শাস্ত্রের শ্লোকই জানে—আর কিছু জানে না। বিদ্যার চরম উদ্দেশ্য যদি হৃদয় প্রশস্ত করা হয়, তাহাদের অধিকাংশেরই পড়াশুনা ব্যর্থ হইয়াছে, তাহা একবারও চিন্তা করি না। মেয়ের কত বয়সে বিবাহ দেওয়া উচিত, জিজ্ঞাসা করিলে তাহারা শাস্ত্র আওড়ায়, বিধবা-বিবাহ উচিত কি না, জানিতে চাহিলে পুঁথি খুলিয়া বসে। মিলাইয়া দেখিতে চায়, শ্লোকে কি বলে, শাস্ত্র তাহাদের দৃষ্টি ক্ষীণ করিয়া রাখিয়াছে। শাস্ত্রের বাহিরে তাহারা দেখিতেও পায় না, শাস্ত্রের বাহিরে তাহারা পা বাড়াইতেও পারে না। ইহারা মুখস্থ করিবার ক্ষমতাকেই বুদ্ধি বলিয়া মনে করে, এবং মুখস্থ করাটাকেই জ্ঞান বলিয়া জানে। এই জ্ঞান ইহাদের অধিকাংশ অবস্থাতেই যে অনুস্বর-বিসর্গকে অতিক্রম করিতে পারে না, তাহার একটা দৃষ্টান্ত দিতেছি।
মহামহোপাধ্যায় স্বর্গীয় চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কার মহাশয় তাঁহার শ্রীগোপাল মল্লিক ফেলোশিপের দ্বিতীয় লেক্চারে নামকরণ প্রণালীর মধ্যে বলিয়াছেন, “কেহ কেহ বলেন, মেরুতন্ত্রে লণ্ডন নগরের উল্লেখ আছে, অতএব উহা নিতান্ত আধুনিক। কিন্তু তাঁহাদের বিবেচনা করা উচিত যে, পুরাণাদিতে অনেক ভবিষ্যদুক্তি আছে। মেরুতন্ত্রেও ভবিষ্যদুক্তি স্থলেই লণ্ডন নগরের উল্লেখ আছে। সুতরাং তদ্দ্বারা মেরুতন্ত্রের আধুনিকত্ব প্রতিপন্ন হইতে পারে না। উহা যে ভবিষ্যদুক্তি, তাহা দেখাইবার জন্য মেরুতন্ত্র হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত হইতেছে—
“পূর্ব্বাম্নায়ে নবশতং ষড়শীতিঃ প্রকীর্ত্তিতা
ফিরিঙ্গি ভাষয়া মন্ত্রা যেষাং সংসাধনাৎ কলৌ।
অধিপামণ্ডলানাঞ্চ সংগ্রামেষ্বপরাজিতাঃ।
ইংরেজা নবষট্ পঞ্চ লণ্ড্রজাশ্চাপিভাবিনঃ।“
অথচ, স্বর্গীয় অক্ষয় দত্ত মহাশয় ছদ্ম শাস্ত্রকারগণের জুয়াচুরি সপ্রমাণ করিতে মেরুতন্ত্রের এই শ্লোকটাই তাঁহার ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়ে’র উপক্রমণিকায় উদ্ধৃত করিয়া গিয়াছেন। ইঁহাদের উভয়ের পাণ্ডিত্যই অতি গভীর ছিল, অথচ একজন যে শ্লোকের অস্তিত্বে শ্লাঘা বোধ করিয়াছেন, আর একজন তাহাকেই ঘৃণার সহিত বর্জন করিয়াছেন। এস্থলে কাহার বিচার সমীচীন, তাহা বুঝিতেও যেমন বিলম্ব হয় না, স্বর্গীয় মহামহোপাধ্যায় মহাশয়ের মত দেশপ্রসিদ্ধ পণ্ডিত চূড়ামণির মুখে এমন কথা, সংস্কৃত শ্লোকের উপর এতবড় অন্ধবিশ্বাস দেখিয়াও আর আশা-ভরসার স্থান থাকে না। পণ্ডিত মহাশয় আবার নিজেই বলিয়াছেন—মেরুতন্ত্রের প্রামাণ্যে সন্দেহ করিবার অন্য কারণ আছে। তাহা এই _পারস্য ভাষায় ও ফিরিঙ্গি ভাষায় যে সকল মন্ত্রের কথা বলা হইয়াছে, তত্তদ্ভাষাবিদেরা জানেন যে, বস্তুগত্যা উহাদের অস্তিত্ব নাই।