ও যে মানে না মানা
ও যে মানে না মানা।
আঁখি ফিরাইলে বলে, ‘না, না, না।’
যত বলি ‘নাই রাতি– মলিন হয়েছে বাতি’
মুখপানে চেয়ে বলে, ‘না, না, না।’
বিধুর বিকল হয়ে খেপা পবনে
ফাগুন করিছে হাহা ফুলের বনে।
আমি যত বলি ‘তবে এবার যে যেতে হবে’
দুয়ারে দাঁড়ায়ে বলে, ‘না, না, না।’
ওই মধুর মুখ জাগে মনে
ওই মধুর মুখ জাগে মনে।
ভুলিব না এ জীবনে, কী স্বপনে কী জাগরণে॥
তুমি জান বা না জান
মনে সদা যেন মধুর বাঁশরি বাজে–
হৃদয়ে সদা আছে ব’লে।
আমি প্রকাশিতে পারি নে, শুধু চাহি কাতর নয়নে॥
ওকে ধরিলে তো ধরা দেবে না
ওকে ধরিলে তো ধরা দেবে না–
ওকে দাও ছেড়ে, দাও ছেড়ে।
মন নাই যদি দিল, নাই দিল,
মন নেয় যদি নিক কেড়ে॥
এ কী খেলা মোরা খেলেছি, শুধু নয়নের জল ফেলেছি–
ওরই জয় যদি হয় জয় হোক, মোরা হারি যদি, যাই হেরে॥
এক দিন মিছে আদরে মনে গরব সোহাগ না ধরে,
শেষে দিন না ফুরাতে ফুরাতে সব গরব দিয়েছে সেরে।
ভেবেছিনু ওকে চিনেছি, বুঝি বিনা পণে ওকে কিনেছি–
ও যে আমাদেরি কিনে নিয়েছে, ও যে, তাই আসে, তাই ফেরে॥
ওকে বাঁধিবি কে রে হবে যে ছেড়ে দিতে
ওকে বাঁধিবি কে রে, হবে যে ছেড়ে দিতে।
ওর পথ খোলে রে বিদায়রজনীতে॥
গগনে তার মেঘদুয়ার ঝেঁপে বুকেরই ধন বুকেতে ছিল চেপে,
প্রভাতবায়ে গেল সে দ্বার কেঁপে–
এল যে ডাক ভোরের রাগিণীতে॥
শীতল হোক বিমল হোক প্রাণ,
হৃদয়ে শোক রাখুক তার দান।
যা ছিল ঘিরে শূন্যে সে মিলালো, সে ফাঁক দিয়ে আসুক তবে আলো–
বিজনে বসি পূজাঞ্জলি ঢালো
শিশিরে-ভরা সেঁউতি-ঝরা গীতে॥
ওকে বল্ সখী বল্
ওকে বল্, সখী বল্– কেন মিছে করে ছল,
মিছে হাসি কেন সখী, মিছে আঁখিজল॥
জানি নে প্রেমের ধারা, ভয়ে তাই হই সারা,
কে জানে কোথায় সুধা কোথা হলাহল॥
কাঁদিতে জানে না এরা, কাঁদাইতে জানে কল–
মুখের বচন শুনে মিছে কী হইবে ফল।
প্রেম নিয়ে শুধু খেলা– প্রাণ নিয়ে হেলাফেলা–
ফিরে যাই এই বেলা, চল্, সখী, চল্॥
ওগো এত প্রেম-আশা প্রাণের তিয়াষা
ওগো এত প্রেম-আশা, প্রাণের তিয়াষা কেমনে আছে সে পাশরি।
তবে সেথা কি হাসে না চাঁদিনী যামিনী, সেথা কি বাজে না বাঁশরি॥
সখী, হেথা সমীরণ লুটে ফুলবন, সেথা কি পবন বহে না।
সে যে তার কথা মোরে কহে অনুক্ষণ, মোর কথা তারে কহে না!
যদি আমারে আজি সে ভুলিবে সজনী, আমারে ভুলালে কেন সে।
ওগো এ চিরজীবন করিব রোদন, এই ছিল তার মানসে!
যবে কুসুমশয়নে নয়নে নয়নে কেটেছিল সুখরাতি রে,
তবে কে জানিত তার বিরহ আমার হবে জীবনের সাথি রে।
যদি মনে নাহি রাখে, সুখে যদি থাকে, তোরা একবার দেখে আয়–
এই নয়নের তৃষা, পরানের আশা, চরণের তলে রেখে আয়।
আর নিয়ে যা রাধার বিরহের ভার, কত আর ঢেকে রাখি বল্।
আর পারিস যদি তো আনিস হরিয়ে এক-ফোঁটা তার আঁখিজল।
না না, এত প্রেম, সখী, ভুলিতে যে পারে তারে আর কেহ সেধো না।
আমি কথা নাহি কব, দুখ লয়ে রব, মনে মনে স’ব বেদনা।
ওগো মিছে মিছে, সখী, মিছে এই প্রেম, মিছে পরানের বাসনা।
ওগো সুখদিন হায় যবে চলে যায় আর ফিরে আর আসে না ॥
ওগো কে যায় বাঁশরি বাজায়ে
ওগো কে যায় বাঁশরি বাজায়ে আমার ঘরে কেহ নাই যে
তারে মনে পড়ে যারে চাই যে॥
তার আকুল পরান, বিরহের গান, বাঁশি বুঝি গেল জানায়ে।
আমি আমার কথা তারে জানাব কী করে, প্রাণ কাঁদে মোর তাই যে॥
কুসুমের মালা গাঁথা হল না, ধূলিতে প’ড়ে শুকায় রে।
নিশি হয় ভোর, রজনীর চাঁদ মলিন মুখ লুকায় রে।
সারা বিভাবরী কার পূজা করি যৌবনডালা সাজায়ে–
বাঁশিস্বরে হায় প্রাণ নিয়ে যায়, আমি কেন থাকি হায় রে॥
ওগো শোনো কে বাজায়
ওগো শোনো কে বাজায়
বনফুলের মালার গন্ধ বাঁশির তানে মিশে যায়॥
অধর ছুঁয়ে বাঁশিখানি চুরি করে হাসিখানি–
বঁধুর হাসি মধুর গানে প্রাণের পানে ভেসে যায়॥
কুঞ্জবনের ভ্রমর বুঝি বাঁশির মাঝে গুঞ্জরে,
বকুলগুলি আকুল হয়ে বাঁশির গানে মুঞ্জরে।
যমুনারই কলতান কানে আসে, কাঁদে প্রাণ–
আকাশে ওই মধুর বিধু কাহার পানে হেসে চায়॥
ওগো কিশোর আজি তোমার দ্বারে
ওগো কিশোর, আজি তোমার দ্বারে পরান মম জাগে।
নবীন কবে করিবে তারে রঙিন তব রাগে॥
ভাবনাগুলি বাঁধনখোলা রচিয়া দিবে তোমার দোলা,
দাঁড়িয়ো আসি হে ভাবে-ভোলা, আমার আঁখি-আগে॥
দোলের নাচে বুঝি গো আছ অমরাবতীপুরে–
বাজাও বেণু বুকের কাছে, বাজাও বেণু দূরে।
শরম ভয় সকলি ত্যেজে মাধবী তাই আসিল সেজে–
শুধায় শুধু, “বাজায় কে যে মধুর মধুসুরে!’
গগনে শুনি একি এ কথা, কাননে কী যে দেখি।
একি মিলনচঞ্চলতা, বিরহব্যথা একি।
আঁচল কাঁপে ধরার বুকে, কী জানি তাহা সুখে না দুখে–
ধরিতে যারে না পারে তারে স্বপনে দেখিছে কি।
লাগিল দোল জলে স্থলে, জাগিল দোল বনে বনে–
সোহাগিনির হৃদয়তলে বিরহিণীর মনে মনে।
মধুর মোরে বিধুর করে সুদূর কার বেণুর স্বরে,
নিখিল হিয়া কিসের তরে দুলিছে অকারণে।
আনো গো আনো ভরিয়া ডালি করবীমালা লয়ে,
আনো গো আনো সাজায়ে থালি কোমল কিশলয়ে।
এসো গো পীত বসনে সাজি, কোলেতে বীণা উঠুক বাজি,
ধ্যানেতে আর গানেতে আজি যামিনী যাক বয়ে।
এসো গো এসো দোলবিলাসী বাণীতে মোর দোলো,
ছন্দে মোর চকিতে আসি মাতিয়ে তারে তোলো।
অনেক দিন বুকের কাছে রসের স্রোত থমকি আছে,
নাচিবে আজি তোমার নাচে সময় তারি হল॥