এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়।
এমন দিনে মন খোলা যায়–
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরোঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়॥
সে কথা শুনিবে না কেহ আর,
নিভৃত নির্জন চারি ধার।
দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি,
আকাশে জল ঝরে অনিবার–
জগতে কেহ যেন নাহি আর॥
সমাজ সংসার মিছে সব,
মিছে এ জীবনের কলরব।
কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে
হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব–
আঁধারে মিশে গেছে আর সব॥
তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার
নামাতে পারি যদি মনোভার।
শ্রাবণবরিষনে একদা গৃহকোণে
দু কথা বলি যদি কাছে তার
তাহাতে আসে যাবে কিবা কার॥
ব্যাকুল বেগে আজি বহে যায়,
বিজুলি থেকে থেকে চমকায়।
যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়–
এমন ঘনঘোর বরিষায়॥
এরা পরকে আপন করে
এরা পরকে আপন করে, আপনারে পর–
বাহিরে বাঁশির রবে ছেড়ে যায় ঘর॥
ভালোবাসে সুখে দুখে ব্যথা সহে হাসিমুখে,
মরণেরে করে চিরজীবননির্ভর॥
এলেম নতুন দেশে
এলেম নতুন দেশে–
তলায় গেল ভগ্ন তরী, কূলে এলেম ভেসে॥
অচিন মনের ভাষা শোনাবে অপূর্ব কোন্ আশা,
বোনাবে রঙিন সুতোয় দুঃখসুখের জাল,
বাজবে প্রাণে নতুন গানের তাল–
নতুন বেদনায় ফিরব কেঁদে হেসে॥
নাম-না-জানা প্রিয়া
নাম-না-জানা ফুলের মালা নিয়া হিয়ায় দেবে হিয়া।
যৌবনেরি নবোচ্ছ্বাসে ফাগুন মাসে
বাজবে নূপুর বনের ঘাসে।
মাতবে দখিনবায় মঞ্জরিত লবঙ্গলতায়
চঞ্চলিত এলো কেশে॥
এসেছি গো এসেছি মন দিতে এসেছি
এসেছি গো এসেছি, মন দিতে এসেছি, যারে ভালো বেসেছি।
ফুলদলে ঢাকি মন যাব রাখি চরণে,
পাছে কঠিন ধরণী পায়ে বাজে।
রেখো রেখো চরণ হৃদি-মাঝে।
নাহয় দ’লে যাবে, প্রাণ ব্যথা পাবে–
আমি তো ভেসেছি, অকূলে ভেসেছি॥
এসো এসো পুরুষোত্তম এসো এসো বীর মম
এসো এসো পুরুষোত্তম, এসো এসো বীর মম।
তোমার পথ চেয়ে আছে প্রদীপ জ্বালা॥
আজি পরিবে বীরাঙ্গনার হাতে দৃপ্ত ললাটে, সখা,
বীরের বরণমালা।
ছিন্ন ক’রে দিবে সে তার শক্তির অভিমান,
তোমার চরণে করিবে দান আত্মনিবেদনের ডালা–
চরণে করিবে দান।
আজপরাবে বীরাঙ্গনা তোমার দৃপ্ত ললাটে সখা,
বীরের বরণমালা॥
এসো আমার ঘরে
এসো আমার ঘরে।
বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে॥
স্বপনদুয়ার খুলে এসো অরুণ-আলোকে
মুগ্ধ এ চোখে।
ক্ষণকালের আভাস হতে চিরকালের তরে এসে আমার ঘরে॥
দুঃখসুখের দোলে এসো, প্রাণের হিল্লোলে এসো।
ছিলে আশার অরূপ বাণী ফাগুনবাতাসে
বনের আকুল নিশ্বাসে–
এবার ফুলের প্রফুল্ল রূপ এসো বুকের ‘পরে॥
এসো এসো ফিরে এসো
এসো এসো ফিরে এসো, বঁধু হে ফিরে এসো।
আমার ক্ষুধিত তৃষিত তাপিত চিত, নাথ হে, ফিরে এসো।
ওহে নিষ্ঠুর, ফিরে এসো,
আমার করুণকোমল এসো,
আমার সজলজলদস্নিগ্ধকান্ত সুন্দর ফিরে এসো,
আমার নিতিসুখ ফিরে এসো,
আমার চিরদুখ ফিরে এসো।
আমার সবসুখদুখমন্থনধন অন্তরে ফিরে এসো।
আমার চিরবাঞ্ছিত এসো,
আমার চিতসঞ্চিত এসো,
ওহে চঞ্চল, হে চিরন্তন, ভুজ- বন্ধনে ফিরে এসো।
আমার বক্ষে ফিরিয়া এসো,
আমার চক্ষে ফিরিয়া এসো,
আমার শয়নে স্বপনে বসনে ভূষণে নিখিল ভুবনে এসো।
আমার মুখের হাসিতে এসো,
আমার চোখের সলিলে এসো,
আমার আদরে আমার ছলনে আমার অভিমানে ফিরে এসো।
আমার সকল স্মরণে এসো,
আমার সকল ভরমে এসো,
আমার ধরম-করম-সোহাগ-শরম-জনম-মরণে এসো ॥
ও দেখা দিয়ে যে চলে গেল
ও দেখা দিয়ে যে চলে গেল ও চুপিচুপি কী বলে গেল।
যেতে যেতে গো, কাননেতে গো ও কত যে ফুলে দ’লে গেল॥
মনে মনে কী ভাবে কে জানে, মেতে আছে ও যেন কী গানে,
নয়ন হানে আকাশ-পানে– চাঁদের হিয়া গ’লে গেল॥
ও পায়ে পায়ে যে বাজায়ে চলে বীণার ধ্বনি তৃণের দলে।
কে জানে কারে ভালো কি বাসে, বুঝিতে নারি কাঁদে কি হাসে,
জানি নে ও কি ফিরিয়া আসে– জানি নে ও কি ছ’লে গেল॥
ও আমার ধ্যানেরই ধন
ও আমার ধ্যানেরই ধন,
তোমার হৃদয়ে দোলায় যে হাসি রোদন॥
আসে বসন্ত, ফোটে বকুল, কুঞ্জে পূর্ণিমাচাঁদ হেসে আকুল–
তারা তোমায় খুঁজে না পায়,
প্রাণের মাঝে আছ গোপন স্বপন॥
আঁখিরে ফাঁকি দাও, একি ধারা!
অশ্রুজলে তারে কর সারা।
গন্ধ আসে, কেন দেখি নে মালা পায়ের ধ্বনি শুনি, পথ নিরালা।
বেলা যে যায়, ফুল যে শুকায়–
অনাথ হয়ে আছে আমার ভুবন॥
ও কেন চুরি ক’রে চায়
ও কেন চুরি ক’রে চায়।
নুকোতে গিয়ে হাসি হেসে পালায়।
বনপথে ফুলের মেলা, হেলে দুলে করে খেলা–
চকিতে সে চমকিয়ে কোথা দিয়ে যায়॥
কী যেন গানের মতো বেজেছে কানের কাছে,
যেন তার প্রাণের কথা আধেকখানি শোনা গেছে।
পথেতে যেতে চ’লে মালাটি গেছে ফেলে–
পরানের আশাগুলি গাঁথা যেন তায়॥
ও চাঁদ চোখের জলের লাগল জোয়ার দুখের পারাবারে
ও চাঁদ, চোখের জলের লাগল জোয়ার দুখের পারাবারে,
হল কানায় কানায় কানাকানি এই পারে ওই পারে॥
আমার তরী ছিল চেনার কূলে, বাঁধন যে তার গেল খুলে;
তারে হাওয়ায় হাওয়ায় নিয়ে গেল কোন্ অচেনার ধারে॥
পথিক সবাই পেরিয়ে গেল ঘাটের কিনারাতে,
আমি সে কোন্ আকুল আলোয় দিশাহারা রাতে।
সেই পথ-হারানোর অধীর টানে অকূলে পথ আপনি টানে,
দিক ভোলাবার পাগল আমার হাসে অন্ধকারে॥