আমি এলেম তারি দ্বারে
আমি এলেম তারি দ্বারে, ডাক দিলেম অন্ধকারে হা রে॥
আগল ধরে দিলেম নাড়া– প্রহরে গেল, পাই নি সাড়া,
দেখতে পেলেম না যে তা রে হা রে॥
তবে যাবার আগে এখান থেকে এই লিখনখানি যাব রেখে–
দেখা তোমার পাই বা না পাই দেখতে এলেম জেনো গো তাই,
ফিরে যাই সুদূরের পারে হা রে॥
আমি চাহিতে এসেছি শুধু একখানি মালা
আমি চাহিতে এসেছি শুধু একখানি মালা
তব নব প্রভাতের নবীন-শিশির-ঢালা ॥
হেরো শরমে-জড়িত কত-না গোলাপ কত-না গরবি করবী,
ওগো, কত-না কুসুম ফুটেছে তোমার মালঞ্চ করি আলা ॥
ওগো, অমল শরত-শীতল-সমীর বহিছে তোমারি কেশে,
ওগো, কিশোর-অরুণ-কিরণ তোমার অধরে পড়েছে এসে।
তব অঞ্চল হতে বনপথে ফুল যেতেছে পড়িয়া ঝরিয়া–
ওগো, অনেক কুন্দ অনেক শেফালি ভরেছে তোমার ডালা ॥
আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী
আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী।
আমি সকল দাগে হব দাগি॥
তোমার পথের কাঁটা করব চয়ন, যেথা তোমার ধুলার শয়ন
সেথা আঁচল পাতব আমার– তোমার রাগে অনুরাগী॥
আমি শুচি-আসন টেনে টেনে বেড়াব না বিধান মেনে,
যে পঙ্কে ওই চরণ পড়ে তাহারি ছাপ বক্ষে মাগি॥
আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ
আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে–
তুমি জান না, আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে॥
সে সাধনায় মিশিয়া যায় বকুলগন্ধ,
সে সাধনায় মিলিয়া যায় কবির ছন্দ–
তুমি জান না, ঢেকে রেখেছি তোমার নাম
রঙিন ছায়ার আচ্ছাদনে॥
তোমার অরূপ মূর্তিখানি
ফাল্গুনের আলোতে বসাই আনি।
বাঁশরি বাজাই ললিত-বসন্তে, সুদূর দিগন্তে
সোনার আভায় কাঁপে তব উত্তরী
গানের তানের সে উন্মাদনে॥
আমি নিশি নিশি কত রচিব শয়ন
আমি নিশি নিশি কত রচিব শয়ন আকুলনয়ন রে।
কত নিতি নিতি বনে করিব যতনে কুসুমচয়ন রে।
কত শারদ যামিনী হইবে বিফল, বসন্ত যাবে চলিয়া।
কত উদিবে তপন, আশার স্বপন প্রভাতে যাইবে ছলিয়া।
এই যৌবন কত রাখিব বাঁধিয়া, মরিব কাঁদিয়া রে।
সেই চরণ পাইলে মরণ মাগিব সাধিয়া সাধিয়া রে।
আমি কার পথ চাহি এ জনম বাহি; কার দরশন যাচি রে।
যেন আসিবে বলিয়া কে গেছে চলিয়া, তাই আমি বসে আছি রে।
তাই মালাটি গাঁথিয়া পরেছি মাথায়, নীলবাসে তনু ঢাকিয়া।
তাই বিজন আলয়ে প্রদীপ জ্বালায়ে একেলা রয়েছি জাগিয়া।
ওগো তাই কত নিশি চাঁদ ওঠে হাসি, তাই কেঁদে যায় প্রভাতে।
ওগো তাই ফুলবনে মধুসমীরণে ফুটে ফুল কত শোভাতে।
ওই বাঁশিস্বর তার আসে বারবার, সেই শুনে কেন আসে না।
এই হৃদয়-আসন শূন্য পড়ে থাকে, কেঁদে মরে শুধু বাসনা।
মিছে পরশিয়া কায় বায়ু বহে যায়, বহে যমুনার লহরী।
কেন কুহু কুহু পিক কুহরিয়া ওঠে, যামিনী যে ওঠে শিহরি।
ওগো, যদি নিশিশেষে আসে হেসে হেসে মোর হাসি আর রবে কি
এই জাগরণে-ক্ষীণ বদনমলিন আমারে হেরিয়া কবে কী।
আমি সারা রজনীর গাঁথা ফুলমালা প্রভাতে চরণে ঝরিব–
ওগো, আছে সুশীতল যমুনার জল, দেখে তারে আমি মরিব॥
আমি নিশিদিন তোমায় ভালোবাসি
আমি নিশিদিন তোমায় ভালোবাসি,
তুমি অবসরমত বাসিয়ো।
নিশিদিন হেথায় বসে আছি,
তোমার যখন মনে পড়ে আসিয়ো ॥
আমি সারানিশি তোমা-লাগিয়া
রব বিরহশয়নে জাগিয়া–
তুমি নিমেষের তরে প্রভাতে
এসে মুখপানে চেয়ে হাসিয়ো ॥
তুমি চিরদিন মধুপবনে
চির- বিকশিত বনভবনে
যেয়ো মনোমত পথ ধরিয়া
তুমি নিজ সুখস্রোতে ভাসিয়ো।
যদি তার মাঝে পড়ি আসিয়া
তবে আমিও চলিব ভাসিয়া,
যদি দূরে পড়ি তাহে ক্ষতি কী–
মোর স্মৃতি মন হতে নাশিয়ো ॥
আমি যাব না গো অমনি চলে
আমি যাব না গো অমনি চলে। মালা তোমার দেব গলে॥
অনেক সুখে অনেক দুখে তোমার বাণী নিলেম বুকে,
ফাগুনশেষে যাবার বেলা আমার বাণী যাব বলে॥
কিছু হল, অনেক বাকি। ক্ষমা আমায় করবে না কি।
গান এসেছে সুর আসে নাই,হল না যে শোনানো তাই–
সে-সুর আমার রইল ঢাকা নয়নজলে॥
আমি রূপে তোমায় ভোলাব না ভালোবাসায় ভোলাব
আমি রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালোবাসায় ভোলাব।
আমি হাত দিয়ে দ্বার খুলব না গো, গান দিয়ে দ্বার খোলাব॥
ভরাব না ভূষণভারে, সাজাব না ফুলের হারে–
প্রেমকে আমার মালা করে গলায় তোমার দোলাব॥
জানবে না কেউ কোন্ তুফানে তরঙ্গদল নাচবে প্রাণে,
চাঁদের মতো অলখ টানে জোয়ারে ঢেউ তোলাব॥
আমি কেবল তোমার দাসী
আমি কেবল তোমার দাসী
কেমন ক’রে আনব মুখে ‘তোমায় ভালোবাসি’॥
গুণ যদি মোর থাকত তবে অনেক আদর মিলত ভবে,
বিনামূল্যের কেনা আমি শ্রীচরণপ্রয়াসী॥
আমি কেবল তোমার দাসী
আমি কেবল তোমার দাসী
কেমন ক’রে আনব মুখে ‘তোমায় ভালোবাসি’॥
গুণ যদি মোর থাকত তবে অনেক আদর মিলত ভবে,
বিনামূল্যের কেনা আমি শ্রীচরণপ্রয়াসী॥
আমি ফুল তুলিতে এলেম বনে
আমি ফুল তুলিতে এলেম বনে–
জানি নে, আমার কী ছিল মনে।
এ তো ফুল তোলা নয়, বুঝি নে কী মনে হয়,
জল ভরে যায় দু নয়নে॥
আমি যে আর সইতে পারি নে
আমি যে আর সইতে পারি নে।
সুরে বাজে মনের মাঝে গো, কথা দিয়ে কইতে পারি নে॥
হৃদয়লতা নুয়ে পড়ে ব্যথাভরা ফুলের ভরে গো,
আমি সে আর বইতে পারি নে॥
আজি আমার নিবিড় অন্তরে॥
কী হাওয়াতে কাঁপিয়ে দিল গো পুলক-লাগা আকুল মর্মরে।
কোন্ গুণী আজ উদাস প্রাতে মীড় দিয়েছে কোন্ বীণাতে গো–
ঘরে যে আর রইতে পারি নে॥