আমার আপন গান আমার অগোচরে
আমার আপন গান আমার অগোচরে আমার মন হরণ করে,
নিয়ে সে যায় ভাসায়ে সকল সীমারই পারে॥
ওই-যে দূরে কূলে কূলে ফাল্গুন উচ্ছ্বসিত ফুলে ফুলে–
সেথা হতে আসে দুরন্ত হাওয়া, লাগে আমার পালে॥
কোথায় তুমি মম অজানা সাথি,
কাটাও বিজনে বিরহরাতি,
এসো এসো উধাও পথের যাত্রী–
তরী আমার টলোমলো ভরা জোয়ারে॥
আমার এ পথ তোমার পথের থেকে
আমার এ পথ তোমার পথের থেকে অনেক দূরে গেছে বেঁকে॥
আমার ফুলে আর কি কবে তোমার মালা গাঁথা হবে,
তোমার বাঁশি দূরের হাওয়ায় কেঁদে বাজে কারে ডেকে॥
শ্রান্তি লাগে পায়ে পায়ে বসি পথের তরুছায়ে।
সাথিহারার গোপন ব্যথা বলব যারে সেজন কোথা–
পথিকরা যায় আপন-মনে, আমারে যায় পিছু রেখে॥
আমার এই রিক্ত ডালি
আমার এই রিক্ত ডালি দিব তোমারি পায়ে।
দিব কাঙালিনীর আঁচল তোমার পথে পথে বিছায়ে॥
যে পুষ্পে গাঁথ পুষ্পধনু তারি ফুলে ফুলে হে অতনু,
আমার পূজা-নিবেদনের দৈন্য দিয়ো ঘুচায়ে॥
তোমার রণজয়ের অভিযানে তুমি আমায় নিয়ো,
ফুলবাণের টিকা আমার ভালে এঁকে দিয়ো দিয়ো!
আমার শূন্যতা দাও যদি সুধায় ভরি দিব তোমার জয়ধ্বনি ঘোষণ করি–
ফাল্গুনের আহ্বান জাগাও আমার কায়ে দক্ষিণবায়ে॥
আমার কণ্ঠ হতে গান কে নিল ভুলায়ে
আমার কণ্ঠ হতে গান কে নিল ভুলায়ে,
সে যে বাসা বাঁধে নীরব মনের কুলায়ে॥
মেঘের দিনে শ্রাবণ মাসে যূথীবনের দীর্ঘশ্বাসে
আমার-প্রাণে সে দেয় পাখার ছায়া বুলায়ে॥
যখন শরৎ কাঁপে শিউলিফুলের হরষে
নয়ন ভরে যে সেই গোপন গানের পরশে।
গভীর রাতে কী সুর লাগায় আধো-ঘুমে আধো-জাগায়,
আমার স্বপন-মাঝে দেয় যে কী দোল দুলায়ে॥
আমার নয়ন তব নয়নের নিবিড় ছায়ায়
আমার নয়ন তব নয়নের নিবিড় ছায়ায়
মনের কথার কুসুমকোরক খোঁজে
সেথায় কখন অগম গোপন গহন মায়ায়
পথ হারাইল ও যে॥
আতুর দিঠিতে শুধায় সে নীরবেরে–
নিভৃত বাণীর সন্ধান নাই যে রে;
অজানার মাঝে অবুঝের মতো ফেরে
অশ্রুধারায় মজে॥
আমার হৃদয়ে যে কথা লুকানো তার আভাষণ
ফেলে কভু ছায়া তোমার হৃদয়তলে?
দুয়ারে এঁকেছি রক্ত রেখায় পদ্ম-আসন,
সে তোমারে কিছু বলে?
তব কুঞ্জের পথ দিয়ে যেতে যেতে
বাতাসে বাতাসে ব্যথা দিই মোর পেতে–
বাঁশি কী আশায় ভাষা দেয় আকাশেতে
সে কি কেহ নাহি বোঝে॥
আমার পরান লয়ে কী খেলা খেলাবে ওগো
আমার পরান লয়ে কী খেলা খেলাবে ওগো
পরানপ্রিয়
কোথা হতে ভেসে কূলে লেগেছে চরণমূলে
তুলে দেখিয়ো ॥
এ নহে গো তৃণদল, ভেসে আসা ফুলফল–
এ যে ব্যথাভরা মন মনে রাখিয়ো ॥
কেন আসে কেন যায় কেহ না জানে।
কে আসে কাহার পাশে কিসের টানে।
রাখ যদি ভালোবেসে চিরপ্রাণ পাইবে সে,
ফেলে যদি যাও তবে বাঁচিবে কি ও॥
আমার লতার প্রথম মুকুল চেয়ে আছে মোর পানে
আমার লতার প্রথম মুকুল চেয়ে আছে মোর পানে,
শুধায় আমারে ‘এসেছি এ কোন্খানে’॥
এসেছ আমার জীবনলীলার রঙ্গে,
এসেছ আমার তরল ভাবের ভঙ্গে,
এসেছ আমার স্বরতরঙ্গ-গানে॥
আমার লতার প্রথম মুকুল প্রভাত-আলোক-মাঝে
শুধায় আমারে ‘এসেছি এ কোন্ কাজে’।
টুটিতে গ্রন্থি কাজের জটিল বন্ধে,
বিবশ চিত্ত ভরিতে অলস গন্ধে,
বাজাতে বাঁশরি প্রেমাতুর দুনয়ানে॥
আমার শেষ রাগিণীর প্রথম ধুয়ো ধরলি রে কে তুই
আমার শেষ রাগিণীর প্রথম ধুয়ো ধরলি রে কে তুই।
আমার শেষ পেয়ালা চোখের জলে ভরলি রে কে তুই॥
দূরে পশ্চিমে ওই দিনের পারে অস্তরবির পথের ধারে
রক্তরাগের ঘোমটা মাথায় পরলি রে কে তুই॥
সন্ধ্যাতারায় শেষ চাওয়া তোর রইল কি ওই-যে।
সন্ধ্যা-হাওয়ায় শেষ বেদনা বইল কি ওই-যে।
তোর হঠাৎ-খসা প্রাণের মালা ভরল আমার শূন্য ডালা–
মরণপথের সাথি আমায় করলি রে কে তুই॥
আমারে করো তোমার বীণা
আমারে করো তোমার বীণা, লহো গো লহো তুলে।
উঠিবে আজি তন্ত্রীরাজি মোহন অঙ্গুলে॥
কোমল তব কমলকরে, পরশ করো পরান-‘পরে,
উঠিবে হিয়া গুঞ্জরিয়া তব শ্রবণমূলে॥
কখনো সুখে কখনো দুখে কাঁদিবে চাহি তোমার মুখে,
চরণে পড়ি রবে নীরবে রহিবে যবে ভুলে।
কেহ না জানে কী নব তানে উঠিবে গীত শূন্য-পানে,
আনন্দের বারতা যাবে অনন্তের কূলে॥
আমায় থাকতে দে-না আপন-মনে
আমায় থাকতে দে-না আপন-মনে।
সেই চরণের পরশখানি মনে পড়ে ক্ষণে ক্ষণে॥
কথার পাকে কাজের ঘোরে ভুলিয়ে রাখে কে আর মোরে,
তার স্মরণের বরণমালা গাঁথি বসে গোপন কোণে॥
এই-যে ব্যথার রতনখানি আমার বুকে দিল আনি
এই নিয়ে আজ দিনের শেষে একা চলি তার উদ্দেশে।
নয়নজলে সামনে দাঁড়াই, তারে সাজাই তারি ধনে॥
আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী
আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী।
তুমি থাক সিন্ধুপারে ওগো বিদেশিনী॥
তোমায় দেখেছি শারদপ্রাতে, তোমায় দেখেছি মাধবী রাতে,
তোমায় দেখেছি হৃদি-মাঝারে ওগো বিদেশিনী।
আমি আকাশে পাতিয়া কান শুনেছি শুনেছি তোমারি গান,
আমি তোমারে সঁপেছি প্রাণ ওগো বিদেশিনী।
ভুবন ভ্রমিয়া শেষে আমি এসেছি নূতন দেশে,
আমি অতিথি তোমারি দ্বারে ওগো বিদেশিনী॥
আমি আশায় আশায় থাকি
আমি আশায় আশায় থাকি।
আমার তৃষিত-আকুল আঁখি॥
ঘুমে-জাগরণে-মেশা প্রাণে স্বপনের নেশা–
দূর দিগন্তে চেয়ে কাহারে ডাকি॥
বনে বনে করে কানাকানি অশ্রুত বাণী,
কী গাহে পাখি।
কী কব না পাই ভাষা, মোর জীবন রঙিন কুয়াশা
ফেলেছে ঢাকি।