আমার মনের কোণের বাইরে
আমার মনের কোণের বাইরে
আমি জানলা খুলে ক্ষণে ক্ষণে চাই রে॥
কোন্ অনেক দূরে উদাস সুরে
আভাস যে কার পাই রে–
আছে-আছে নাই রে॥
আমার দুই আঁখি হল হারা,
কোন্ গগনে খোঁজে কোন্ সন্ধ্যাতারা।
কার ছায়া আমায় ছুঁয়ে যে যায়,
কাঁপে হৃদয় তাই রে–
গুন্গুনিয়ে গাই রে॥
আমার যদি বেলা যায় গো বয়ে জেনো জেনো
আমার যদি বেলা যায় গো বয়ে জেনো জেনো
আমার মন রয়েছে তোমায় লয়ে॥
পথের ধারে আসন পাতি, তোমায় দেবার মালা গাঁথি–
জেনো জেনো তাইতে আছি মগন হয়ে॥
চলে গেল যাত্রী সবে
নানান পথে কলরবে।
আমার চলা এমনি ক’রে আপন হাতে সাজি ভ’রে–
জেনো জেনো আপন মনে গোপন রয়ে॥
আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে
আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে
ভোরের আলো মেঘের ফাঁকে ফাঁকে॥
বাদলপ্রাতের উদাস পাখি ওঠে ডাকি।
বনের গোপন শাখে শাখে, পিছু ডাকে॥
ভরা নদী ছায়ার তলে ছুটে চলে–
খোঁজে কাকে, পিছু ডাকে।
আমার প্রাণের ভিতর সে কে থেকে থেকে
বিদায়প্রাতের উতলাকে পিছু ডাকে॥
আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়
আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়।
আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথে যে জন ভাসায়॥
যে জন দেয় না দেখা যায় যে দেখে ভালোবাসে আড়াল থেকে,
আমার মন মজেছে সেই গভীরের গোপন ভালোবাসায়॥
আমার একটি কথা বাঁশি জানে
আমার একটি কথা বাঁশি জানে, বাঁশিই জানে॥
ভরে রইল বুকের তলা, কারো কাছে হয় নি বলা,
কেবল বলে গেলেম বাঁশির কানে কানে॥
আমার চোখে ঘুম ছিল না গভীর রাতে,
চেয়ে ছিলেম চেয়ে থাকা তারার সাথে।
এমনি গেল সারা রাতি, পাই নি আমার জায়গা সাথি–
বাঁশিটিরে জাগিয়ে গেলেম গানে গানে॥
আমার ভুবন তো আজ হল কাঙাল
আমার ভুবন তো আজ হল কাঙাল, কিছু তো নাই বাকি,
ওগো নিঠুর, দেখতে পেলে তা কি॥
তার সব ঝরেছে, সব মরেছে, জীর্ণ বসন ওই পরেছে–
প্রেমের দানে নগ্ন প্রাণের লজ্জা দেহো ঢাকি॥
কুঞ্জে তাহার গান যা ছিল কোথায় গেল ভাসি।
এবার তাহার শূন্য হিয়ায় বাজাও তোমার বাঁশি।
তার দীপের আলো কে নিভালো, তারে তুমি জ্বালো জ্বালো–
আমার আপন আঁধার আমার আঁখিরে দেয় ফাঁকি॥
আমার মন কেমন করে
আমার মন কেমন করে–
কে জানে, কে জানে, কে জানে কাহার তরে॥
অলখ পথের পাখি গেল ডাকি,
গেল ডাকি সুদূর দিগন্তরে
ভাবনাকে মোর ধাওয়ায়
সাগরপারের হাওয়ায় হাওয়ায় হাওয়ায়।
স্বপনবলাকা মেলেছে পাখা,
আমায় বেঁধেছে কে সোনার পিঞ্জরে ঘরে॥
আমার যেতে সরে না মন
আমার যেতে সরে না মন–
তোমার দুয়ার পারায়ে আমি যাই যে হারায়ে
অতল বিরহে নিমগন॥
চলিতে চলিতে পথে সকলই দেখি যেন মিছে,
নিখিল ভুবন পিছে ডাকে অনুক্ষণ॥
আমার মনে কেবলই বাজে
তোমায় কিছু দেওয়া হল না যে।
যবে চলে যাই পদে পদে বাধা পাই,
ফিরে ফিরে আসি অকারণ॥
আমার নিশীথরাতের বাদলধারা
আমার নিশীথরাতের বাদলধারা, এসো হে গোপনে
আমার স্বপনলোকে দিশাহারা ॥
ওগো অন্ধকারের অন্তরধন, দাও ঢেকে মোর পরান মন–
আমি চাই নে তপন, চাই নে তারা ॥
যখন সবাই মগন ঘুমের ঘোরে নিয়ো গো, নিয়ো গো,
আমার ঘুম নিয়ো গো হরণ করে।
একলা ঘরে চুপ চুপে এসো কেবল সুরের রূপে–
দিয়ো গো, দিয়ো গো,
আমার চোখের জলের দিয়ো সাড়া ॥
আমার নয়ন তোমার নয়নতলে মনের কথা খোঁজে
আমার নয়ন তোমার নয়নতলে মনের কথা খোঁজে,
সেথায় কালো ছায়ার মায়ার ঘোরে পথ হারালো ও যে॥
নীরব দিঠে শুধায় যত পায় না সাড়া মনের মতো,
অবুঝ হয়ে রয় সে চেয়ে অশ্রুধারায় ম’জে॥
তুমি আমার কথার আভাখানি পেয়েছ কি মনে।
এই-যে আমি মালা আনি, তার বাণী কেউ শোনে?
পথ দিয়ে যাই, যেতে যেতে হাওয়ায় ব্যথা দিই যে পেতে–
বাঁশি বিছায় বিষাদ-ছায়া তার ভাষা কেউ বোঝে॥
আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে চাও কি
আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে, চাও কি–
হায় বুঝি তার খবর পেলে না।
পারিজাতের মধুর গন্ধ পাও কি–
হায় বুঝি তার নাগাল মেলে না ॥
প্রেমের বাদল নামল, তুমি জানো না হায় তাও কি।
আজ মেঘের ডাকে তোমার মনের ময়ূরকে নাচাও কি।
আমি সেতারেতে তার বেঁধেছি, আমি সুরলোকের সুর সেধেছি,
তারি তানে তানে মনে প্রাণে মিলিয়ে গলা গাও কি–
হায় আসরেতে বুঝি এলে না।
ডাক উঠেছে বারে বারে, তুমি সাড়া দাও কি!
আজ ঝুলনদিনে দোলন লাগে, তোমার পরান হেলে না ॥
আমার মন চেয়ে রয় মনে মনে
আমার মন চেয়ে রয় মনে মনে হেরে মাধুরী।
নয়ন আমার কাঙাল হয়ে মরে না ঘুরি॥
চেয়ে চেয়ে বুকের মাঝে গুঞ্জরিল একতারা যে–
মনোরথের পথে পথে বাজল বাঁশুরি।
রূপের কোলে ওই-যে দোলে অরূপ মাধুরী॥
কূলহারা কোন্ রসের সরোবরে মূলহারা ফুল ভাসে জলের ‘পরে।
হাতের ধরা ধরতে গেলে ঢেউ দিয়ে তায় দিই যে ঠেলে–
আপন-মনে স্থির হয়ে রই, করি নে চুরি।
ধরা দেওয়ার ধন সে তো নয়, অরূপ মাধুরী॥
আমার মনের মাঝে যে গান বাজে
আমার মনের মাঝে যে গান বাজে শুনতে কি পাও গো
আমার চোখের ‘পরে আভাস দিয়ে যখনি যাও গো ॥
রবির কিরণ নেয় যে টানি ফুলের বুকের শিশিরখানি,
আমার প্রাণের সে গান তুমি তেমনি কি নাও গো ॥
আমার উদাস হৃদয় যখন আসে বাহির-পানে
আপনাকে যে দেয় ধরা সে সকলখানে।
কচি পাতা প্রথম প্রাতে কী কথা কয় আলোর সাথে,
আমার মনের আপন কথা বলে যে তাও গো ॥