সেই ভালো সেই ভালো আমারে নাহয় না জানো
সেই ভালো সেই ভালো, আমারে নাহয় না জানো।
দূরে গিয়ে নয় দুঃখ দেবে, কাছে কেন লাজে লাজানো ॥
মোর বসন্তে লেগেছে তো সুর, বেণুবনছায়া হয়েছে মধুর–
থাক-না এমনি গন্ধে-বিধুর মিলনকুঞ্জ সাজানো।
গোপনে দেখেছি তোমার ব্যাকুল নয়নে ভাবের খেলা।
উতল আঁচল, এলোথেলো চুল, দেখেছি ঝড়ের বেলা।
তোমাতে আমাতে হয় নি যে কথা মর্মে আমার আছে সে বারতা–
না বলা বাণীর নিয়ে আকুলতা আমার বাঁশিটি বাজানো ॥
সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে
সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে, ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা।
সেই স্মৃতিটুকু কভু খনে খনে যেন জাগে মনে, ভুলো না ॥
সেদিন বাতাসে ছিল তুমি জানো– আমারি মনের প্রলাপ জড়ানো,
আকাশে আকাশে আছিল ছড়ানো তোমার হাসির তুলনা ॥
যেতে যেতে পথে পূর্ণিমারাতে চাঁদ উঠেছিল গগনে।
দেখা হয়েছিল তোমাতে আমাতে কী জানি কী মহা লগনে।
এখন আমার বেলা নাহি আর, বহিব একাকী বিরহের ভার–
বাঁধিনু যে রাখী পরানে তোমার সে রাখী খুলো না, খুলো না ॥
স্বপনে দোঁহে ছিনু কী মোহে জাগার বেলা হল
স্বপনে দোঁহে ছিনু কী মোহে, জাগার বেলা হল–
যাবার আগে শেষ কথাটি বোলো ॥
ফিরিয়া চেয়ে এমন কিছু দিয়ো
বেদনা হবে পরমরমণীয়–
আমার মনে রহিবে নিরবধি
বিদায়খনে খনেক-তরে যদি সজল আঁখি তোলো ॥
নিমেষহারা এ শুকতারা এমনি উষাকালে
উঠিবে দূরে বিরহাকাশভালে।
রজনীশেষে এই-যে শেষ কাঁদা
বীণার তারে পড়িল তাহা বাঁধা,
হারানো মণি স্বপনে গাঁথা রবে–
হে বিরহিণী, আপন হাতে তবে বিদায়দ্বার খোলো।
স্বপ্নমদির নেশায় মেশা এ উন্মত্ততা
স্বপ্নমদির নেশায় মেশা এ উন্মত্ততা,
জাগায় দেহে মনে একি বিপুল ব্যথা॥
বহে মম শিরে শিরে একি দাহ, কী প্রবাহ,
চকিতে সর্বদেহে ছুটে তড়িৎলতা॥
ঝড়ের পবনগর্জে হারাই আপনায়,
দুরন্ত যৌবনক্ষুব্ধ অশান্ত বন্যায়।
তরঙ্গ উঠে প্রাণে দিগন্তে কাহার পানে–
ইঙ্গিতের ভাষায় কাঁদে নাহি নাহি কথা॥
হল না লো হল না সই
হল না লো, হল না, সই, হায়–
মরমে মরমে লুকানো রহিল, বলা হল না।
বলি বলি বলি তারে কত মনে করিনু–
হল না লো, হল না সই॥
না কিছু কহিল, চাহিয়া রহিল,
গেল সে চলিয়া, আর সে ফিরিল না।
ফিরাব ফিরাব ব’লে কত মনে করিনু–
হল না লো, হল না সই॥
হাসিরে কি লুকাবি লাজে
হাসিরে কি লুকাবি লাজে,
চপলা সে বাঁধা পড়ে না যে॥
রুধিয়া অধর-দ্বারে ঝাঁপিতে রাখিলি যারে
কখন সে ছুটে এল নয়নমাঝে॥
হায় অতিথি এখনি কি হল তোমার যাবার বেলা
হায় অতিথি, এখনি কি হল তোমার যাবার বেলা।
দেখো আমার হৃদয়তলে সারা রাতের আসন মেলা ॥
এসেছিলে দ্বিধাভরে
কিছু বুঝি চাবার তরে,
নীরব চোখে সন্ধ্যালোকে খেয়াল নিয়ে করলে খেলা।
জানালে না গানের ভাষায় এনেছিলে যে প্রত্যাশা।
শাখার আগায় বসল পাখি, ভুলে গেল বাঁধতে বাসা।
দেখা হল, হয় নি চেনা–
প্রশ্ন ছিল, শুধালে না–
আপন মনের আকাঙক্ষারে আপনি কেন করলে হেলা ॥
হায় গো ব্যথায় কথা যায় ডুবে যায়
হায় গো, ব্যথায় কথা যায় ডুবে যায়, যায় গো–
সুর হারালেম অশ্রুধারে॥
তরী তোমার সাগরনীরে, আমি ফিরি তীরে তীরে,
ঠাঁই হল না তোমার সোনার নায় গো–
পথ কোথা পাই অন্ধকারে॥
হায় গো, নয়ন আমার মরে দুরাশায় গো,
চেয়ে থাকি দাঁড়িয়ে দ্বারে।
যে ঘরে ওই প্রদীপ জ্বলে তার ঠিকানা কেউ না বলে,
বসে থাকি পথের নিরালায় গো
চির-রাতের পাথার-পারে॥
হায় রে ওরে যায় না কি জানা
হায় রে, ওরে যায় না কি জানা
নয়ন ওরে খুঁজে বেড়ায়, পায় না ঠিকানা ॥
অলখ পথেই যাওয়া আসা, শুনি চরণধ্বনির ভাষা–
গন্ধে শুধু হাওয়ায় হাওয়ায় রইল নিশানা ॥
কেমন করে জানাই তারে
বসে আছি পথের ধারে
প্রাণে এল সন্ধ্যাবেলা আলোয় ছায়ায় রঙিন খেলা–
ঝরে-পড়া বকুলদলে বিছায় বিছানা ॥
হায় হতভাগিনী স্রোতে বৃথা গেল ভেসে
হায় হতভাগিনী,
স্রোতে বৃথা গেল ভেসে–
কূলে তরী লাগে নি, লাগে নি॥
কাটালি বেলা বীণাতে সুর বেঁধে, কঠিন টানে উঠল কেঁদে,
ছিন্ন তারে থেমে গেল যে রাগিণী॥
এই পথের ধারে এসে
ডেকে গেছে তোরে সে।
ফিরায়ে দিলি তারে রুদ্ধদ্বারে–
বুক জ্বলে গেল গো, ক্ষমা তবুও কেন মাগি নি॥
হৃদয়ের এ কূল ও কূল দু কূল ভেসে যায়
হৃদয়ের এ কূল, ও কূল, দু কূল ভেসে যায়, হায় সজনি,
উথলে নয়নবারি।
যে দিকে চেয়ে দেখি ওগো সখী,
কিছু আর চিনিতে না পারি॥
পরানে পড়িয়াছে টান,
ভরা নদীতে আসে বান,
আজিকে কী ঘোর তুফান সজনি গো,
বাঁধ আর বাঁধিতে নারি॥
পরানে পড়িয়াছে টান,
ভরা নদীতে আসে বান,
আজিকে কী ঘোর তুফান সজনি গো,
বাঁধ আর বাঁধিতে নারি॥
কেন এমন হল গো, আমার এই নবযৌবনে।
সহসা কী বহিল কোথাকার কোন্ পবনে।
হৃদয় আপনি উদাস, মরমে কিসের হুতাশ–
জানি না কী বাসনা, কী বেদনা গো–
কেমনে আপনা নিবারি॥
হে ক্ষণিকের অতিথি
হে ক্ষণিকের অতিথি,
এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া
ঝরা শেফালির পথ চাহিয়া ॥
কোন্ অমরার বিরহিণীরে চাহ নি ফিরে,
কার বিষাদের শিশিরনীরে এলে নাহিয়া ॥
ওগো অকরুণ, কী মায়া জানো,
মিলনছলে বিরহ আনো।
চলেছ পথিক আলোকযানে আঁধার-পানে
মনভুলানো মোহনতানে গান গাহিয়া ॥