সব কিছু কেন নিল না
সব কিছু কেন নিল না, নিল না, নিল না ভালোবাসা–
ভালো আর মন্দেরে।
আপনাতে কেন মিটাল না যত কিছু দ্বন্দ্বেরে–
ভালো আর মন্দেরে।
নদী নিয়ে আসে পঙ্কিল জলধারা, সাগরহৃদয়ে গহনে হয় হারা।
ক্ষমার দীপ্তি দেয় স্বর্গের আলো প্রেমের আনন্দেরে–
ভালো আর মন্দেরে॥
সবার সাথে চলতেছিল অজানা এই পথের অন্ধকারে
সবার সাথে চলতেছিল অজানা এই পথের অন্ধকারে,
কোন্ সকালের হঠাৎ আলোয় পাশে আমার দেখতে পেলেম তারে॥
এক নিমেষেই রাত্রি হল ভোর, চিরদিনের ধন যেন সে মোর,
পরিচয়ের অন্ত যেন কোনোখানে নাইকো একেবারে–
চেনা কুসুম ফুটে আছে না-চেনা এই গহন বনের ধারে
অজানা এই পথের অন্ধকারে॥
জানি জানি দিনের শেষে সন্ধ্যাতিমির নামবে পথের মাঝে–
আবার কখন পড়বে আড়াল, দেখাশোনার বাঁধন রবে না যে।
তখন আমি পাব মনে মনে পরিচয়ের পরশ ক্ষণে ক্ষণে,
জানব চিরদিনের পথে আঁধার আলোয় চলছি সারে সারে–
হৃদয়-মাঝে দেখব খুঁজে একটি মিলন সব-হারানোর পারে
অজানা এই পথের অন্ধকারে॥
সমুখেতে বহিছে তটিনী
সমুখেতে বহিছে তটিনী, দুটি তারা আকাশে ফুটিয়া।
বায়ু বহে পরিমল লুটিয়া
সাঁঝের অধর হতে ম্লান হাসি পড়িছে টুটিয়া॥
দিবস বিদায় চাহে, যমুনা বিলাপ গাহে–
সায়াহ্নেরি রাঙা পায়ে, কেঁদে কেঁদে পড়িছে লুটিয়া॥
এসো বঁধূ, তোমায় ডাকি– দোঁহে হেথা ব’সে থাকি,
আকাশের পানে চেয়ে জলদের খেলা দেখি,
আঁখি-‘পরে তারাগুলি একে একে উঠিবে ফুটিয়া॥
সময় কারো যে নাই
সময় কারো যে নাই, ওরা চলে দলে দলে–
গান হায় ডুবে যায় কোন্ কোলাহলে॥
পাষাণে রচিছে কত কীর্তি ওরা সবে বিপুল গরবে,
যায় আর বাঁশি-পানে চায় হাসিছলে॥
বিশ্বের কাজের মাঝে জানি আমি জানি
তুমি শোন মোর গানখানি।
আঁধার মথন করি যবে লও তুলি গ্রহতারাগুলি
শোন যে নীরবে তব নীলাম্বরতলে॥
সাজাব তোমারে হে ফুল দিয়ে দিয়ে
সাজাব তোমারে হে ফুল দিয়ে দিয়ে,
নানা বরণের বনফুল দিয়ে দিয়ে॥
আজি বসন্তরাতে পূর্ণিমাচন্দ্রকরে
দক্ষিণপবনে, প্রিয়ে,
সাজাব তোমারে হে ফুল দিয়ে দিয়ে॥
সুখে আছি সুখে আছি সখা আপন মনে
সুখে আছি, সুখে আছি সখা, আপন মনে।
কিছু চেয়ো না, দূরে যেয়ো না,
শুধু চেয়ে দেখো, শুধু ঘিরে থাকো কাছাকাছি।
সখা, নয়নে শুধু জানাবে প্রেম, নীরবে দিবে প্রাণ,
রচিয়া ললিতমধুর বাণী আড়ালে গাবে গান।
গোপনে তুলিয়া কুসুম গাঁথিয়া রেখে যাবে মালাগাছি।
মন চেয়ো না, শুধু চেয়ে থাকো, শুধু ঘিরে থাকো কাছাকাছি॥
মধুর জীবন, মধুর রজনী, মধুর মলয়-বায়।
এই মাধুরীধারা বহিছে আপনি, কেহ কিছু নাহি চায়।
আমি আপনার মাঝে আপনি হারা, আপন সৌরভে সারা,
যেন আপনার মন, আপনার প্রাণ, আপনারে সঁপিয়াছি॥
সুনীল সাগরের শ্যামল কিনারে
সুনীল সাগরের শ্যামল কিনারে
দেখেছি পথে যেতে তুলনাহীনারে॥
এ কথা কভু আর পারে না ঘুচিতে,
আছে সে নিখিলের মাধুরীরুচিতে।
এ কথা শিখানু যে আমার বীণারে,
গানেতে চিনালেম সে চির-চিনারে॥
সে কথা সুরে সুরে ছড়াব পিছনে
স্বপনফসলের বিছনে বিছনে।
মধুপগুঞ্জে সে লহরী তুলিবে,
কুকুমকুঞ্জে সে পবনে দুলিবে,
ঝরিবে শ্রাবণের বাদলসিচনে।
শরতে ক্ষীণ মেঘে ভাসিবে আকাশে
স্মরণবেদনার বরনে আঁকা সে।
চকিতে ক্ষণে ক্ষণে পাব যে তাহারে
ইমনে কেদারায় বেহাগে বাহারে॥
সুন্দর হৃদিরঞ্জন তুমি নন্দনফুলহার
সুন্দর হৃদিরঞ্জন তুমি নন্দনফুলহার,
তুমি অনন্ত নববসন্ত অন্তরে আমার॥
নীল অম্বর চুম্বননত, চরণে ধরণী মুগ্ধ নিয়ত,
অঞ্চল ঘেরি সঙ্গীত যত গুঞ্জরে শতবার॥
ঝলকিছে কত ইন্দুকিরণ, পুলকিছে ফুলগন্ধ–
চরণভঙ্গ ললিত অঙ্গে চমকে চকিত ছন্দ।
ছিঁড়ি মর্মের শত বন্ধন তোমা-পানে ধায় যত ক্রন্দন–
লহো হৃদয়ের ফুলচন্দন বন্দন-উপহার।
সে আমার গোপন কথা শুনে যা ও সখী
সে আমার গোপন কথা শুনে যা ও সখী!
ভেবে না পাই বলব কী॥
প্রাণ যে আমার বাঁশি শোনে নীল গগনে,
গান হয়ে যায় নিজের মনে যাহাই বকি॥
সে যেন আসবে আমার মন বলেছে,
হাসির ‘পরে তাই তো চোখের জল গলেছে।
দেখ্ লো তাই দেয় ইশারা তারায় তারা,
চাঁদ হেসে ওই হল সারা তাহাই লখি॥
সে আসে ধীরে
সে আসে ধীরে,
যায় লাজে ফিরে।
রিনিকি রিনিক রিনিঝিনি মঞ্জু মঞ্জু মঞ্জরী
রিনিঝিনি-ঝিন্নীরে॥
বিকচ নীপকুঞ্জে নিবিড়তিমিরপুঞ্জে
কুন্তলফুলগন্ধ আসে অন্তরমন্দিরে
উন্মদ সমীরে॥
শঙ্কিত চিত কম্পিত অতি, অঞ্চল উড়ে চঞ্চল।
পুষ্পিত তৃণবীথি, ঝঙ্কৃত বনগীতি–
কোমলপদপল্লবতলচুম্বিত ধরণীরে
নিকুঞ্জকুটীরে॥
সে যে পাশে এসে বসেছিল
সে যে পাশে এসে বসেছিল, তবু জাগি নি।
কী ঘুম তোরে পেয়েছিল হতভাগিনি॥
এসেছিল নীরব রাতে, বীণাখানি ছিল হাতে–
স্বপনমাঝে বাজিয়ে গেল গভীর রাগিণী॥
জেগে দেখি দখিন-হাওয়া, পাগল করিয়া
গন্ধ তাহার ভেসে বেড়ায় আঁধার ভরিয়া।
কেন আমার রজনী যায়, কাছে পেয়ে কাছে না পায়–
কেন গো তার মালার পরশ বুকে লাগি নি॥
সে যে বাহির হল আমি জানি
সে যে বাহির হল আমি জানি,
বক্ষে আমার বাজে তাহার বাণী॥
কোথায় কবে এসেছে সে সাগরতীরে, বনের শেষে,
আকাশ করে সেই কথারই কানাকানি॥
হায় রে, আমি ঘর বেঁধেছি এতই দূরে,
না জানি তার আসতে হবে কত ঘুরে।
হিয়া আমার পেতে রেখে সারাটি পথ দিলেম ঢেকে,
আমার ব্যথায় পড়ুক তাহার চরণখানি॥