আমরা দুজনা স্বর্গ-খেলনা গড়িব না ধরণীতে
আমরা দুজনা স্বর্গ-খেলনা গড়িব না ধরণীতে
মুগ্ধ ললিত অশ্রুগলিত গীতে॥
পঞ্চশরের বেদনামাধুরী দিয়ে
বাসরররাত্রি রচিব না মোরা প্রিয়ে–
ভাগ্যের পায়ে দুর্বল প্রাণে ভিক্ষা না যেন যাচি।
কিছু নাই ভয়, জানি নিশ্চয় তুমি আছ আমি আছি।
উড়াব ঊর্ধ্বে প্রেমের নিশান দুর্গমপথমাঝে
দুর্দম বেগে দুঃসহতম কাজে।
রুক্ষ দিনের দুঃখ পাই তো পাব–
চাই না শান্তি, সান্ত্বনা নাহি চাব।
পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি, ছিন্ন পালের কাছি,
মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছ আমি আছি।
দুজনের চোখে দেখেছি জগৎ, দোঁহারে দেখেছি দোঁহে–
মরুপথতাপ দুজনে নিয়েছি সহে।
ছুটি নি মোহন মরীচিকা-পিছে -পিছে,
ভুলাই নি মন সত্যেরে করি মিছে–
এই গৌরবে চলিব এ ভবে যত দিন দোঁহে বাঁচি।
এ বাণী, প্রেয়সী, হোক মহীয়সী “তুমি আছ আমি আছি”॥
আমার জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছ দান
আমার জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছ দান–
তুমি জান নাই, তুমি জান নাই,
তুমি জান নাই তার মূল্যের পরিমাণ॥
রজনীগন্ধা অগোচরে
যেমন রজনী স্বপনে ভরে সৌরভে,
তুমি জান নাই, তুমি জান নাই,
তুমি জান নাই, মরমে আমার ঢেলেছ তোমার গান॥
বিদায় নেবার সময় এবার হল–
প্রসন্ন মুখ তোলো, মুখ তোলো, মুখ তোলো–
মধুর মরণে পূর্ণ করিয়া সঁপিয়া যাব প্রাণ চরণে।
যারে জান নাই, যারে জান নাই, যারে জান নাই,
তার গোপন ব্যথার নীরব রাত্রি হোক আজি অবসান॥
আমার জ্বলে নি আলো অন্ধকারে
আমার জ্বলে নি আলো অন্ধকারে
দাও না সাড়া কি তাই বারে বারে॥
তোমার বাঁশি আমার বাজে বুকে কঠিন দুখে, গভীর সুখে–
যে জানে না পথ কাঁদাও তারে॥
চেয়ে রই রাতের আকাশ-পানে,
মন যে কী চায় তা মনই জানে।
আশা জাগে কেন অকারণে আমার মনে ক্ষণে ক্ষণে,
ব্যথার টানে তোমায় আনবে দ্বারে॥
আমার দোসর যে জন ওগো তারে কে জানে
আমার দোসর যে জন ওগো তারে কে জানে
একতারা তার দেয় কি সাড়া আমার গানে কে জানে॥
আমার নদীর যে ঢেউ ওগো জানে কি কেউ
যায় বহে যায় কাহার পানে। কে জানে॥
যখন বকুল ঝ’রে
আমার কাননতল যায় গো ভ’রে
তখন কে-আসে-যায় সেই বনছায়ায়,
কে সাজি তার ভরে আনে। কে জানে॥
আমার নিখিল ভুবন হারালেম আমি যে
আমার নিখিল ভুবন হারালেম আমি যে।
বিশ্ববীণায় রাগিনী যায় থামি যে॥
গৃহহারা হৃদয় হায় আলোহারা পথে ধায়,
গহন তিমিরগুহাতলে যাই নামি যে॥
তোমারি নয়নে সন্ধ্যাতারার আলো।
আমার পথের অন্ধকারে জ্বালো জ্বালো।
মরীচিকার পিছে পিছে তৃষ্ণাতপ্ত প্রহর কেটেছে মিছে,
দিন-অবসানে
তোমারি হৃদয়ে শ্রান্ত-পান্থ অমৃততীর্থগামী যে॥
আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি
আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি। আনন্দে বিষাদে মন উদাসী॥
পুষ্পবিকাশের সুরে দেহ মন উঠে পূরে,
কী মাধুরী সুগন্ধ বাতাসে যায় ভাসি॥
সহসা মনে জাগে আশা, মোর আহুতি পেয়েছে অগ্নির ভাষা।
আজ মম রূপে বেশে লিপি লিখি কার উদ্দেশে–
এল মর্মের বন্দিনী বাণী বন্ধন নাশি॥
আমার পরান যাহা চায় তুমি তাই
আমার পরান যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাই গো।
তোমা ছাড়া আর এ জগতে মোর কেহ নাই কিছু নাই গো॥
তুমি সুখ যদি নাহি পাও, যাও সুখের সন্ধানে যাও–
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে, আর কিছু নাহি চাই গো॥
আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন, তোমাতে করিব বাস,
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ মাস।
যদি আর-কারে ভালোবাস, যদি আর ফিরে নাহি আস,
তবে, তুমি যাহা চাও, তাই যেন পাও, আমি যত দুখ পাই গো॥
আমার প্রাণের ‘পরে চলে গেল কে
আমার প্রাণের ‘পরে চলে গেল কে
বসন্তের বাতাসটুকুর মতো।
সে যে ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল রে–
ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত।
সে চলে গেল, বলে গেল না– সে কোথায় গেল ফিরে এল না।
সে যেতে যেতে চেয়ে গেল কী যেন গেয়ে গেল–
তাই আপন-মনে বসে আছি কুসুমবনেতে।
সে ঢেউয়ের মতন ভেসে গেছে, চাঁদের আলোর দেশে গেছে,
যেখান দিয়ে হেসে গেছে, হাসি তার রেখে গেছে রে–
মনে হল আঁখির কোণে আমায় যেন ডেকে গেছে সে।
আমি কোথায় যাব, কোথায় যাব, ভাবতেছি তাই একলা বসে।
সে চাঁদের চোখে বুলিয়ে গেল ঘুমের ঘোর।
সে প্রাণের কোথায় দুলিয়ে গেল ফুলের ডোর।
কুসুমবনের উপর দিয়ে কী কথা সে বলে গেল,
ফুলের গন্ধ পাগল হয়ে সঙ্গে তারি চলে গেল।
হৃদয় আমার আকুল হল, নয়ন আমার মুদে এলে রে–
কোথা দিয়ে কোথায় গেল সে॥
আমার মন বলে চাই চা ই চাই গো
আমার মন বলে, ‘চাই চা ই, চাই গো– যারে নাহি পাই গো’।
সকল পাওয়ার মাঝে আমার মনে বেদন বাজে–
‘নাই, না ই নাই গো’॥
হারিয়ে যেতে হবে,
আমায় ফিরিয়ে পাব তবে,
সন্ধ্যাতারা যায় যে চলে ভোরের তারায় জাগবে ব’লে–
বলে সে, ‘যা ই যা ই যাই গো’॥
আমার মন মানে না
আমার মন মানে না– দিনরজনী।
আমি কী কথা স্মরিয়া এ তনু ভরিয়া পুলক রাখিতে নারি।
ওগো, কী ভাবিয়া মনে এ দুটি নয়নে উথলে নয়নবারি–
ওগো সজনি॥
সে সুধাবচন, সে সুখপরশ, অঙ্গে বাজিছে বাঁশি।
তাই শুনিয়া শুনিয়া আপনার মনে হৃদয় হয় উদাসী–
কেন না জানি॥
ওগো, বাতাসে কী কথা ভেসে চলে আসে, আকাশে কী মুখ জাগে।
ওগো, বনমর্মরে নদীনির্ঝরে কী মধুর সুর লাগে।
ফুলের গন্ধ বন্ধুর মতো জড়ায়ে ধরিছে গলে–
আমি এ কথা, এ ব্যথা, সুখব্যাকুলতা কাহার চরণতলে
দিব নিছনি॥