যে ছিল আমার স্বপনচারিণী
যে ছিল আমার স্বপনচারিণী
তারে বুঝিতে পারি নি।
দিন চলে গেছে খুঁজিতে খুঁজিতে॥
শুভক্ষণে কাছে ডাকিলে,
লজ্জা আমার ঢাকিলে গো,
তোমারে সহজে পেরেছি বুঝিতে॥
কে মোরে ফিরাবে অনাদরে,
কে মোরে ডাকিবে কাছে,
কাহার প্রেমের বেদনায় আমার মূল্য আছে,
এ নিরন্তর সংশয়ে হায় পারি নে যুঝিতে–
আমি তোমারেই শুধু পেরেছি বুঝিতে॥
যে দিন সকল মুকুল গেল ঝরে
যে দিন সকল মুকুল গেল ঝরে
আমায় ডাকলে কেন গো, এমন করে॥
যেতে হবে যে পথে বেয়ে শুকনো পাতা আছে ছেয়ে,
হাতে আমার শূন্য ডালা কী ফুল দিয়ে দেবো ভরে॥
গানহারা মোর হৃদয়তলে
তোমার ব্যাকুল বাঁশি কী যে বলে।
নেই আয়োজন, নেই মম ধন, নেই আভরণ, নেই আবরণ–
রিক্ত বাহু এই তো আমার বাঁধবে তোমায় বাহুডোরে॥
যে ফুল ঝরে সেই তো ঝরে
যে ফুল ঝরে সেই তো ঝরে, ফুল তো থাকে ফুটিতে–
বাতাস তারে উড়িয়ে নে যায়, মাটি মেশায় মাটিতে॥
গন্ধ দিলে, হাসি দিলে, ফুরিয়ে গেল খেলা।
ভালোবাসা দিয়ে গেল, তাই কি হেলাফেলা ॥
যেয়ো না যেয়ো না ফিরে
যেয়ো না, যেয়ো না ফিরে,
দাঁড়াও বারেক, দাঁড়াও হৃদয়-আসনে॥
চঞ্চল সমীরসম ফিরিছ কেন কুসুমে কুসুমে, কাননে কাননে।
তোমায় ধরিতে চাহি, ধরিতে পারি নে, তুমি গঠিত যেন স্বপনে–
এসো হে, তোমারে বারেক দেখি ভরিয়ে আঁখি, ধরিয়া রাখি যতনে॥
প্রাণের মাঝে তোমারে ঢাকিব, ফুলের পাশে বাঁধিয়ে রাখিব–
তুমি দিবসনিশি রহিবে মিশি কোমল প্রেমশয়নে॥
যৌবনসরসীনীরে মিলনশতদল
যৌবনসরসীনীরে মিলনশতদল
কোন্ চঞ্চল বন্যায় টলোমল টলোমল॥
শরমরক্তরাগে তার গোপন স্বপ্ন জাগে,
তারি গন্ধকেশর-মাঝে
এক বিন্দু নয়নজল॥
ধীরে বও ধীরে বও, সমীরণ,
সবেদন পরশন।
শঙ্কিত চিত্ত মোর পাছে ভাঙে বৃন্তডোর–
তাই অকারণ করুণায় মোর আঁখি করে ছলোছল॥
রাতে রাতে আলোর শিখা রাখি জ্বেলে
রাতে রাতে আলোর শিখা রাখি জ্বেলে
ঘরের কোণে আসন মেলে॥
বুঝি সময় হল এবার আমার প্রদীপ নিবিয়ে দেবার–
পূর্ণিমাচাঁদ, তুমি এলে॥
এত দিন সে ছিল তোমার পথের পাশে
তোমার দরশনের আশে।
আজ তারে যেই পরশিবে যাক সে নিবে, যাক সে নিবে–
যা আছে সব দিক সে ঢেলে॥
রোদনভরা এ বসন্ত
রোদনভরা এ বসন্ত সখী কখনো আসে নি বুঝি আগে।
মোর বিরহবেদনা রাঙালো কিংশুকরক্তিমরাগে॥
কুঞ্জদ্বারে বনমল্লিকা সেজেছে পরিয়া নব পত্রালিকা,
সারা দিন-রজনী অনিমিখা কার পথ চেয়ে জাগে॥
দক্ষিণসমীরে দূর গগনে একেলা বিরহী গাহে বুঝি গো।
কুঞ্জবনে মোর মুকুল যত আবরণবন্ধন ছিঁড়িতে চাহে।
আমি এ প্রাণের রুদ্ধ দ্বারে ব্যাকুল কর হানি বারে বারে–
দেওয়া হল না যে আপনারে এই ব্যথা মনে লাগে॥
লিখন তোমার ধুলায় হয়েছে ধূলি
লিখন তোমার ধুলায় হয়েছে ধূলি,
হারিয়ে গিয়েছে তোমার আখরগুলি॥
চৈত্ররজনী আজ বসে আছি একা, পুন বুঝি দিল দেখা–
বনে বনে তব লেখনীলীলার রেখা,
নবকিশলয়ে গো কোন্ ভুলে এল ভুলি তোমার পুরানো আখরগুলি॥
মল্লিকা আজি কাননে কাননে কত
সৌরভে-ভরা তোমারি নামের মতো।
কোমল তোমার অঙ্গুলি-ছোঁওয়া বাণী মনে দিল আজি আনি
বিরহের কোন্ ব্যথাভরা লিপিখানি।
মাধবীশাখায় উঠিতেছে দুলি দুলি তোমার পুরানো আখরগুলি॥
লুকালে ব’লেই খুঁজে বাহির করা
লুকালে ব’লেই খুঁজে বাহির করা,
ধরা যদি দিতে তবে যেত না ধরা ॥
পাওয়া ধন আনমনে হারাই যে অযতনে,
হারাধন পেলে সে যে হৃদয়-ভরা ॥
আপনি যে কাছে এল দূরে সে আছে,
কাছে যে টানিয়া আনে সে আসে কাছে।
দূরে বারি যায় চলে, লুকায় মেঘের কোলে,
তাই সে ধরায় ফেরে পিপাসাহারা ॥
শুনি ক্ষণে ক্ষণে মনে মনে
শুনি ক্ষণে ক্ষণে মনে মনে অতল জলের আহ্বান।
মন রয় না, রয় না, রয় না ঘরে, চঞ্চল প্রাণ॥
ভাসায়ে দিব আপনারে, ভরা জোয়ারে,
সকল-ভাবনা-ডুবানো ধারায় করিব স্নান–
ব্যর্থ বাসনার দাহ হবে নির্বাণ॥
ঢেউ দিয়েছে জলে।
ঢেউ দিল, ঢেউ দিল, ঢেউ দিল আমার মর্মতলে।
এ কী ব্যাকুলতা আজি আকাশে, এই বাতাসে,
যেন উতলা অপ্সরীর উত্তরীয় করে রোমাঞ্চদান–
দূর সিন্ধুতীরে কার মঞ্জীরে গুঞ্জরতান॥
শুভ মিলনলগনে বাজুক বাঁশি
শুভ মিলনলগনে বাজুক বাঁশি
মেঘযুক্ত গগনে জাগুক হাসি॥
কত দুঃখে কত দূরে দূরে আঁধারসাগর ঘুরে ঘুরে
সোনার তরী তীরে এল ভাসি।
পূর্ণিমা-আকাশে জাগুক হাসি॥
ওগো পুরবালা,
আনো সাজিয়ে বরণডালা,
যুগলমিলনমহোৎসবে শুভ শঙ্খরবে
বসন্তের আনন্দ দাও উচ্ছ্বাসি।
পূর্ণিমা-আকাশে জাগুক হাসি॥
শেষ বেলাকার শেষের গানে
শেষ বেলাকার শেষের গানে
ভোরের বেলার বেদন আনে॥
তরুণ মুখের করুণ হাসি গোধূলি-আলোয় উঠেছে ভাসি,
প্রথম ব্যথার প্রথম বাঁশি
বাজে দিগন্তে কী সন্ধানে শেষের গানে॥
আজি দিনান্তে মেঘের মায়া
সে আঁখিপাতার ফেলেছে ছায়া।
খেলায় খেলায় যে কথাখানি
চোখে চোখে যেত বিজলি হানি
সেই প্রভাতের নবীন বাণী
চলেছে রাতের স্বপন-পানে শেষের গানে॥
শ্রাবণের পবনে আকুল বিষণ্ন সন্ধ্যায়
শ্রাবণের পবনে আকুল বিষণ্ন সন্ধ্যায়
সাথিহারা ঘরে মন আমার
প্রবাসী পাখি ফিরে যেতে চায়
দূরকালের অরণ্যছায়াতলে॥
কী জানি সেথা আছে কিনা আজও বিজনে বিরহী হিয়া
নীপবনগন্ধঘন অন্ধকারে–
সাড়া দিবে কি গীতহীন নীরব সাধনায়॥
হায়, জানি সে নাই জীর্ণ নীড়ে, জানি সে নাই নাই।
তীর্থহারা যাত্রী ফিরে ব্যর্থ বেদনায়–
ডাকে তবু হৃদয় মম মনে-মনে রিক্ত ভুবনে
রোদন-জাগা সঙ্গীহারা অসীম শূন্যে শূন্যে॥