যখন এসেছিলে অন্ধকারে
যখন এসেছিলে অন্ধকারে
চাঁদ ওঠে নি সিন্ধুপারে॥
হে অজানা, তোমায় তবে জেনেছিলেম অনুভবে–
গানে তোমার পরশখানি বেজেছিল প্রাণের তারে॥
তুমি গেলে যখন একলা চলে
চাঁদ উঠেছে রাতের কোলে।
তখন দেখি, পথের কাছে মালা তোমার পড়ে আছে–
বুঝেছিলেম অনুমানে এ কণ্ঠহার দিলে কারে॥
যখন ভাঙল মিলন-মেলা
যখন ভাঙল মিলন-মেলা
ভেবেছিলুম ভুলব না আর চক্ষের জল ফেলা ॥
দিনে দিনে পথের ধুলায় মালা হতে ফুল ঝরে যায়–
জানি নে তো কখন এল বিস্মরণের বেলা ॥
দিনে দিনে কঠিন হল কখন বুকের তল–
ভেবেছিলেম ঝরবে না আর আমার চোখের জল।
হঠাৎ দেখা পথের মাঝে, কান্না তখন থামে না যে–
ভোলার তলে তলে ছিল অশ্রুজলের খেলা ॥
যদি বারণ কর তবে গাহিব না
যদি বারণ কর তবে গাহিব না।
যদি শরম লাগে মুখে চাহিব না।
যদি বিরলে মালা গাঁথা
সহসা পায় বাধা
তোমার ফুলবনে যাইব না ॥
যদি থমকি থেমে যাও পথমাঝে
আমি চমকি চলে যাব আন কাজে।
যদি তোমার নদীকূলে
ভুলিয়া ঢেউ তুলে,
আমার তরীখানি বাহিব না ॥
যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা
যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোমায় জানাতাম।
কে যে আমায় কাঁদায় আমি কী জানি তার নাম॥
কোথায় যে হাত বাড়াই মিছে, ফিরি আমি কাহার পিছে–
সব যেন মোর বিকিয়েছে, পাই নি তাহার দাম॥
এই বেদনার ধন সে কোথায় ভাবি জনম ধ’রে।
ভুবন ভরে আছে যেন, পাই নে জীবন ভরে।
সুখ যারে কয় সকল জনে বাজাই তারে ক্ষণে ক্ষণে–
গভীর সুরে “চাই নে’ “চাই নে’ বাজে অবিশ্রাম॥
যদি আসে তবে কেন যেতে চায়
যদি আসে তবে কেন যেতে চায়।
দেখা দিয়ে তবে কেন গো লুকায়॥
চেয়ে থাকে ফুল হৃদয় আকুল–
বায়ু বলে এসে ‘ভেসে যাই’।
ধরে রাখো, ধরে রাখো–
সুখপাখি ফাঁকি দিয়ে উড়ে যায়॥
পথিকের বেশে সুখনিশি এসে
বলে হেসে হেসে ‘মিশে যাই’।
জেগে থাকো, সখী, জেগে থাকো–
বরষের সাধ নিমেষে মিলায়॥
যদি হল যাবার ক্ষণ
যদি হল যাবার ক্ষণ
তবে যাও দিয়ে যাও শেষের পরশন॥
বারে বারে যেথায় আপন গানে স্বপন ভাসাই দূরের পানে
মাঝে মাঝে দেখে যেয়ো শূন্য বাতায়ন–
সে মোর শূন্য বাতায়ন॥
বনের প্রান্তে ওই মালতীলতা
করুণ গন্ধে কয় কী গোপন কথা।
ওরই ডালে আজ শ্রাবণের পাখি স্মরণখানি আনবে না কি,
আজ-শ্রাবণের সজল ছায়ায় বিরহ মিলন–
আমাদের বিরহ মিলন॥
যদি হায় জীবন পূরণ নাই হল মম
যদি হায় জীবন পূরণ নাই হল মম তব অকৃপণ করে,
মন তবু জানে জানে–
চকিত ক্ষণিক আলোছায়া তব আলিপন আঁকিয়া যায়
ভাবনার প্রাঙ্গণে॥
বৈশাখের শীর্ণ নদী ভরা স্রোতের দান না পায় যদি
তবু সঙ্কুচিত তীরে তীরে
ক্ষীণ ধারায় পলাতক পরশখানি দিয়ে যায়,
পিয়াসি লয় তাহা ভাগ্য মানি॥
মম ভীরু বাসনার অঞ্জলিতে
যতটুকু পাই রয় উচ্ছলিতে।
দিবসের দৈন্যের সঞ্চয় যত
যত্নে ধরে রাখি,
সে যে রজনীর স্বপ্নের আয়োজন॥
যা ছিল কালো ধলো তোমার রঙে রঙে রাঙা হল
যা ছিল কালো ধলো তোমার রঙে রঙে রাঙা হল।
যেমন রাঙাবরন তোমার চরণ তার সনে আর ভেদ না র’ল॥
রাঙা হল বসন ভূষণ, রাঙা হল শয়ন স্বপন–
মন হল কেমন দেখ্ রে, যেমন রাঙা কমল টলমল॥
যাক ছিঁড়ে যাক ছিঁড়ে যাক মিথ্যার জাল
যাক ছিঁড়ে, যাক ছিঁড়ে যাক মিথ্যার জাল।
দুঃখের প্রসাদে এল আজি মুক্তির কাল॥
এই ভালো ওগো এই ভালো বিচ্ছেদবহ্নিশিখার আলো,
নিষ্ঠুর সত্য করুক বরদান–
ঘুচে যাক ছলনার অন্তরাল॥
যাও প্রিয়, যাও তুমি যাও জয়রথে–
বাধা দিব না পথে,
বিদায় নেবার আগে মন তব স্বপ্ন হতে যেন জাগে–
নির্মল হোক হোক সব জঞ্জাল॥
যাবার বেলা শেষ কথাটি যাও বলে
যাবার বেলা শেষ কথাটি যাও বলে,
কোন্খানে যে মন লুকানো দাও বলে॥
চপল লীলা ছলনাভরে বেদনখানি আড়াল করে,
যে বাণী তব হয় নি বলা নাও বলে॥
হাসির বাণে হেনেছ কত শ্লেষকথা,
নয়নজলে ভরো গো আজি শেষ কথা।
হায় রে অভিমানিনী নারী, বিরহ হল দ্বিগুণ ভারী
দানের ডালি ফিরায়ে নিতে চাও ব’লে॥
যায় নিয়ে যায় আমায় আপন গানের টানে
যায় নিয়ে যায় আমায় আপন গানের টানে
ঘর-ছাড়া কোন্ পথের পানে॥
নিত্যকালের গোপন কথা বিশ্বপ্রাণের ব্যাকুলতা
আমার বাঁশি দেয় এনে দেয় আমার কানে॥
মনে যে হয় আমার হৃদয় কুসুম হয়ে ফোটে,
আমার হিয়া উচ্ছলিয়া সাগরে ঢেউ ওঠে।
পরান আমার বাঁধন হারায় নিশীথরাতের তারায় তারায়,
আকাশ আমায় কয় কী-যে কয় কেউ বা জানে॥
যুগে যুগে বুঝি আমায় চেয়েছিল সে
যুগে যুগে বুঝি আমায় চেয়েছিল সে।
সেই যেন মোর পথের ধারে রয়েছে বসে॥
আজ কেন মোর পড়ে মনে কখন্ তারে চোখের কোণে
দেখেছিলেম অফুট প্রদোষে–
সেই যেন মোর পথের ধারে রয়েছে বসে॥
আজ ওই চাঁদের বরণ হবে আলোর সঙ্গীতে,
রাতের মুখের আঁধারখানি খুলবে ইঙ্গিতে।
শুক্লরাতে সেই আলোকে দেখা হবে এক পলকে,
সব আবরণ যাবে যে খসে।
সেই যেন মোর পথের ধারে রয়েছে বসে॥
যে ছায়ারে ধরব বলে করেছিলেম পণ
যে ছায়ারে ধরব বলে করেছিলেম পণ
আজ সে মেনে নিল আমার গানেরই বন্ধন ॥
আকাশে যার পরশ মিলায় শরতমেঘের ক্ষণিক লীলায়
আপন সুরে আজ শুনি তার নূপুরগুঞ্জন ॥
অলস দিনের হাওয়ায়
গন্ধখানি মেলে যেত গোপন আসা-যাওয়ায়।
আজ শরতের ছায়ানটে মোর রাগিণীর মিলন ঘটে,
সেই মিলনের তালে তালে বাজায় সে কঙ্কণ ॥