মনে রবে কি না রবে আমারে
মনে রবে কি না রবে আমারে সে আমার মনে নাই।
ক্ষণে ক্ষণে আসি তব দুয়ারে, অকারণে গান গাই॥
চলে যায় দিন, যতখন আছি পথে যেতে যদি আসি কাছাকাছি
তোমার মুখের চকিত সুখের হাসি দেখিতে যে চাই—
তাই অকারণে গান গাই॥
ফাগুনের ফুল যায় ঝরিয়া ফাগুনের অবসানে—
ক্ষণিকের মুঠি দেয় ভরিয়া, আর কিছু নাহি জানে।
ফুরাইবে দিন, আলো হবে ক্ষীণ, গান সারা হবে, থেমে যাবে বীন,
যতখন থাকি ভরে দিবে নাকি এ খেলারই ভেলাটাই—
তাই অকারণে গান গাই॥
মনে রয়ে গেল মনের কথা
মনে রয়ে গেল মনের কথা–
শুধু চোখের জল, প্রাণের ব্যথা ॥
মনে করি দুটি কথা ব’লে যাই, কেন মুখের পানে চেয়ে চলে যাই।
সে যদি চাহে মরি যে তাহে, কেন মুদে আসে আঁখির পাতা ॥
ম্লানমুখে, সখী, সে যে চলে যায়– ও তারে ফিরায়ে ডেকে নিয়ে আয়
বুঝিল না সে যে কেঁদে গেল– ধুলায় লুটাইল হৃদয়লতা।
মম দুঃখের সাধন যবে করিনু নিবেদন
মম দুঃখের সাধন যবে করিনু নিবেদন তব চরণতলে
শুভলগন গেল চলে,
প্রেমের অভিষেক কেন হল না তব নয়নজলে॥
রসের ধারা নামিল না, বিরহে তাপের দিনে ফুল গেল শুকায়ে–
মালা পরানো হল না তব গলে॥
মনে হয়েছিল দেখেছিনু করুণা তব আঁখিনিমেষে,
গেল সে ভেসে।
যদি দিতে বেদনার দান, আপনি পেতে তারে ফিরে
অমৃতফলে॥
মম রুদ্ধমুকুলদলে এসো সৌরভ-অমৃতে
মম রুদ্ধমুকুলদলে এসো সৌরভ-অমৃতে,
মম অখ্যাততিমিরতলে এসো গৌরবনিশীথে॥
এই মূল্যহারা মম শুক্তি, এসো মুক্তাকণায় তুমি মুক্তি–
মম মৌনী বীণার তারে এসো সঙ্গীতে॥
নব অরুণের এসো আহ্বান,
চিররজনীর হোক অবসান– এসো।
এসো শুভস্মিত শুকতারায়, এসো শিশির-অশ্রুধারায়,
সিন্দুর পরাও উষারে তব রশ্মিতে॥
মম যৌবননিকুঞ্জে গাহে পাখি
মম যৌবননিকুঞ্জে গাহে পাখি–
সখি, জাগ’ জাগ’
মেলি রাগ-অলস আঁখি–
অনু রাগ-অলস আঁখি সখি, জাগ’ জাগ’॥
আজি চঞ্চল এ নিশীথে
জাগ’ ফাগুনগুণগীতে
অয়ি প্রথমপ্রণয়ভীতে,
মম নন্দন-অটবীতে
পিক মূহু মূহু উঠে ডাকি– সখি, জাগ’ জাগ’॥
জাগ’ নবীন গৌরবে,
নব বকুলসৌরভে,
মৃদু মলয়াবীজনে
জাগ’ নিভৃত নির্জনে।
আজি আকুল ফুলসাজে
জাগ’ মৃদুকম্পিত লাজে,
মম হৃদয়শয়নমাঝে,
শুন মধুর মুরলী বাজে
মমঅন্তরে থাকি থাকি– সখি, জাগ’ জাগ’॥
মরি লো মরি আমার বাঁশিতে ডেকেছে কে
মরি লো মরি, আমার বাঁশিতে ডেকেছে কে॥
ভেবেছিলেম ঘরে রব, কোথাও যাব না–
ওই-যে বাহিরে বাজিল বাঁশি, বলো কী করি॥
শুনেছি কোন্ কুঞ্জবনে যমুনাতীরে
সাঁঝের বেলায় বাজে বাঁশি ধীর সমীরে–
ওগো, তোরা জানিস যদি আমায় পথ বলে দে॥
দেখি গে তার মুখের হাসি,
তারে ফুলের মালা পরিয়ে আসি,
তারে বলে আসি ‘তোমার বাঁশি
আমার প্রাণে বেজেছে’॥
মান অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে আয়
মান অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে আয়–
তারে এগিয়ে নিয়ে আয়॥
চোখের জলে মিশিয়ে হাসি ঢেলে দে তার পায়–
ওরে, ঢেলে দে তার পায়। ।
আসছে পথে ছায়া পড়ে, আকাশ এল আঁধার করে,
শুষ্ক কুসুম পড়ছে ঝরে, সময় বহে যায়–
ওরে সময় বহে যায়॥
মিলনরাতি পোহালো বাতি নেভার বেলা এল
মিলনরাতি পোহালো, বাতি নেভার বেলা এল–
ফুলের পালা ফুরালে ডালা উজাড় করে ফেলো ॥
স্মৃতির ছবি মিলাবে যবে ব্যথার তাপ কিছু তো রবে,
তা নিয়ে মনে বিজন খনে বিরহদীপ জ্বেলো ॥
ফাল্গুনের মাধবীলীলা কুঞ্জ ছিল ঘিরে,
চৈত্রবনে বেদনা তারি মর্মরিয়া ফিরে।
হয়েছে শেষ, তবুও বাকি কিছু তো গান গিয়েছি রাখি–
সেটুকু নিয়ে গুন্গুনিয়ে সুরের খেলা খেলো ॥
মুখখানি কর মলিন বিধুর যাবার বেলা
মুখখানি কর মলিন বিধুর যাবার বেলা–
জানি আমি জানি, সে তব মধুর ছলের খেলা ॥
গোপন চিহ্ন এঁকে যাবে তব রথে–
জানি তুমি তারে ভুলিবে না কোনোমতে
যার সাথে তব হল এক দিন মিলনমেলা ॥
জানি আমি যবে আঁখিজল ভরে রসের স্নানে
মিলনের বীজ অঙ্কুর ধরে নবীন প্রাণে।
খনে খনে এই চিরবিরহের ভান,
খনে খনে এই ভয়রোমাঞ্চদান–
তোমার প্রণয়ে সত্য সোহাগে মিথ্যা হেলা ॥
মুখপানে চেয়ে দেখি ভয় হয় মনে
মুখপানে চেয়ে দেখি, ভয় হয় মনে–
ফিরেছ কি ফের নাই বুঝিব কেমনে॥
আসন দিয়েছি পাতি, মালিকা রেখেছি গাঁথি,
বিফল হল কি তাহা ভাবি খনে খনে॥
গোধূলিলগনে পাখি ফিরে আসে নীড়ে,
ধানে ভরা তরীখানি ঘাটে এসে ভিড়ে।
আজো কি খোঁজার শেষে ফের কি আপন দেশে।
বিরামবিহীন তৃষা জ্বলে কি নয়নে॥
মেঘছায়ে সজল বায়ে মন আমার
মেঘছায়ে সজল বায়ে মন আমার
উতলা করে সারাবেলা কার লুপ্ত হাসি, সুপ্ত বেদনা হয় রে॥
কোন্ বসন্তের নিশীথে যে বকুলমালাখানি পরালে
তার দলগুলি গেছে ঝরে, শুধু গন্ধ ভাসে প্রাণে॥
জানি ফিরিবে না আর ফিরিবে না, জানি তব পথ গেছে সুদূরে
পারিলে না তবু পারিলে না চিরশূন্য করিতে ভুবন মম–
তুমি নিয়ে গেছ মোর বাঁশিখানি, দিয়ে গেছ তোমার গান॥
মোর স্বপন-তরীর কে তুই নেয়ে
মোর স্বপন-তরীর কে তুই নেয়ে।
লাগল পালে নেশার হাওয়া, পাগল পরান চলে গেয়ে।
আমায় ভুলিয়ে দিয়ে যা তোর দুলিয়ে দিয়ে না,
ও তোর সুদূর ঘাটে চল্ রে বেয়ে।
আমার ভাবনা তো সব মিছে, আমার সব পড়ে থাক্ পিছে।
তোমারঘোমটা খুলে দাও তোমার নয়ন তুলে চাও,
দাও হাসিতে মোর পরান ছেয়ে॥