বিরস দিন বিরল কাজ
বিরস দিন বিরল কাজ, প্রবল বিদ্রোহে
এসেছ প্রেম, এসেছ আজ কী মহা সমারোহে॥
একেলা রই অলসমন, নীরব এই ভবনকোণ,
ভাঙিলে দ্বার কোন্ সে ক্ষণ অপরাজিত ওহে॥
কানন-‘পরছায়া বুলায়, ঘনায় ঘনঘটা।
গঙ্গা যেন হেসে দুলায় ধূর্জটির জটা।
যেথা যে রয় ছাড়িল পথ, ছুটালে ওই বিজয়রথ,
আঁখি তোমার তড়িতবৎ ঘনঘুমের মোহে॥
বিরহ মধুর হল আজি মধুরাতে
বিরহ মধুর হল আজি মধুরাতে।
গভীর রাগিণী উঠে বাজি বেদনাতে॥
ভরি দিয়া পূর্ণিমানিশা অধীর অদর্শনতৃষা
কী করুণ মরীচিকা আনে আঁখিপাতে॥
সুদূরের সুগন্ধধারা বায়ুভরে
পরানে আমার পথহারা ঘুরে মরে।
কার বাণী কোন্ সুরে তালে মর্মরে পল্লবজালে,
বাজে মম মঞ্জীররাজি সাথে সাথে॥
বুঝি বেলা বহে যায়
বুঝি বেলা বহে যায়,
কাননে আয় তোরা আয়।
আলোতে ফুল উঠল ফুটে, ছায়ায় ঝরে পড়ে যায়॥
সাধ ছিল রে পরিয়ে দেব মনের মতন মালা গেঁথে–
কই সে হল মালা গাঁথা, কই সে এল হায়।
যমুনার ঢেউ যাচ্ছে বয়ে, বেলা চলে যায়॥
বেদনায় ভরে গিয়েছে পেয়ালা
বেদনায় ভরে গিয়েছে পেয়ালা, নিয়ো হে নিয়ো।
হৃদয় বিদারি হয়ে গেল ঢালা, পিয়ো হে পিয়ো ॥
ভরা সে পাত্র, তারে বুকে ক’রে বেড়ানু বহিয়া সারা রাতি ধরে,
লও তুলে লও আজি নিশিভোর প্রিয় হে প্রিয়॥
বাসনার রঙে লহরে লহরে রঙিন হল।
করুণ তোমার অরুণ অধরে তোলো হে তোলো।
এ রসে মিশাক তব নিশ্বাস নবীন উষার পুষ্পসুবাস–
এরই ‘পরে তব আঁখির আভাস দিয়ো হে দিয়ো ॥
বড়ো বেদনার মতো বেজেছ তুমি হে আমার প্রাণে
বড়ো বেদনার মতো বেজেছ তুমি হে আমার প্রাণে,
মন যে কেমন করে মনে মনে তাহা মনই জানে॥
তোমারে হৃদয়ে ক’রে আছি নিশিদিন ধ’রে,
চেয়ে থাকি আঁখি ভ’রে মুখের পানে॥
বড়ো সুখে, বড়ো দুখে, বড়ো অনুরাগে রয়েছি জাগি।
এ জন্মের মতো আর হয়ে গেছে যা হবার,
ভেসে গেছে মন প্রাণ মরণ টানে॥
ভরা থাক্ স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি
ভরা থাক্ স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি।
মিলনের উৎসবে তায় ফিরায়ে দিয়ো আনি॥
বিষাদের অশ্রুজলে নীরবের মর্মতলে
গোপনে উঠুক ফলে হৃদয়ের নূতন বাণী॥
যে পথে যেতে হবে সে পথে তুমি একা–
নয়নে আঁধার রবে, ধেয়ানে আলোকরেখা।
সারা দিন সঙ্গোপনে সুধারস ঢালবে মনে
পরানের পদ্মবনে বিরহের বীণাপাণি॥
ভালোবাসি ভালোবাসি
ভালোবাসি, ভালোবাসি–
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি॥
আকাশে কার বুকের মাঝে ব্যথা বাজে,
দিগন্তে কার কালো আঁখি আঁখির জলে যায় ভাসি॥
সেই সুরে সাগরকূলে বাঁধন খুলে
অতল রোদন উঠে দুলে।
সেই সুরে বাজে মনে অকারণে
ভুলে-যাওয়া গানের বাণী, ভোলা দিনের কাঁদন-হাসি॥
ভালোবেসে যদি সুখ নাহি
ভালোবেসে যদি সুখ নাহি তবে কেন,
তবে কেন মিছে ভালোবাসা।
মন দিয়ে মন পেতে চাহি। ওগো কেন,
ওগো, কেন মিছে এ দুরাশা॥
হৃদয়ে জ্বালায়ে বাসনার শিখা, নয়নে সাজায়ে মায়ামরীচিকা,
শুধু ঘুরে মরি মরুভূমে। ওগো, কেন
ওগো, কেন মিছে এ পিপাসা॥
আপনি যে আছে আপনার কাছে,
নিখিল জগতে কী অভাব আছে।
আছে মন্দ সমীরণ, পুষ্পবিভূষণ,
কোকিলকূজিত কুঞ্জ।
বিশ্বচরাচর লুপ্ত হয়ে যায়– এ কী ঘোর প্রেম অন্ধরাহু-প্রায়
জীবন যৌবন গ্রাসে। তবে কেন,
তবে কেন মিছে এ কুয়াশা॥
ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে
ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো– তোমার
মনের মন্দিরে।
আমার পরানে যে গান বাজিছে
তাহার তালটি শিখো– তোমার
চরণমঞ্জীরে॥
ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে
আমার মুখর পাখি– তোমার
প্রাসাদপ্রাঙ্গণে॥
মনে ক’রে সখী, বাঁধিয়া রাখিয়ো
আমার হাতের রাখী– তোমার
কনককঙ্কণে॥
আমার লতার একটি মুকুল
ভুলিয়া তুলিয়া রেখো– তোমার
অলকবন্ধনে।
আমার স্মরণ শুভ-সিন্দুরে
একটি বিন্দু এঁকো– তোমার
ললাটচন্দনে।
আমার মনের মোহের মাধুরী
মাখিয়া রাখিয়া দিয়ো– তোমার
অঙ্গসৌরভে।
আমার আকুল জীবনমরণ
টুটিয়া লুটিয়া নিয়ো– তোমার
অতুল গৌরবে॥
ভুল করেছিনু ভুল ভেঙেছে
ভুল করেছিনু ভুল ভেঙেছে।
জেগেছি, জেনেছি– আর ভুল নয়, ভুল নয়॥
মায়ার পিছে পিছে ফিরেছি, জেনেছি স্বপনসম সব মিছে–
বিঁধেছে কাঁটা প্রাণে– এ তো ফুল নয় ফুল নয়॥
ভালোবাসা হেলা করিব না,
খেলা করিব না নিয়ে মন– হেলা করিব না।
তব হৃদয়ে সখী, আশ্রয় মাগি।
অতল সাগর সংসারে এ তো কূল নয় কূল নয়॥
মন জানে মনোমোহন আইল
মন জানে মনোমোহন আইল, মন জানে সখা!
তাই কেমন করে আজি আমার প্রাণে॥
তারি সৌরভ বহি বহিল কি সমীরণ আমার পরানপানে॥
মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে
মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে সে দিন ভরা সাঁঝে,
যেতে যেতে দুয়ার হতে কী ভেবে ফিরালে মুখখানি–
কী কথা ছিল যে মনে॥
তুমি সে কি হেসে গেলে আঁখিকোণে–
আমি বসে বসে ভাবি নিয়ে কম্পিত হৃদয়খানি,
তুমি আছ দূর ভুবনে॥
আকাশে উড়িছে বকপাঁতি,
বেদনা আমার তারি সাথি।
বারেক তোমায় শুধাবারে চাই বিদায়কালে কী বল নাই,
সে কি রয়ে গেল গো সিক্ত যূথীর গন্ধবেদনে॥
মনে যে আশা লয়ে এসেছি হল না
মনে যে আশা লয়ে এসেছি হল না, হল না হে।
ওই মুখপানে চেয়ে ফিরিনু লুকাতে আঁখিজল,
বেদনা রহিল মনে মনে॥
তুমি কেন হেসে চাও, হেসে যাও হে, আমি কেন কেঁদে ফিরি–
কেন আমি কম্পিত হৃদয়খানি, কেন যাও দূরে না দেখে॥