বল্ গোলাপ মোরে বল্
বল্, গোলাপ, মোরে বল্,
তুই ফুটিবি, সখী, কবে।
ফুল ফুটেছে চারি পাশ, চাঁদ হাসিছে সুধাহাস,
বায়ু ফেলিছে মৃদু শ্বাস, পাখি গাইছে মধুরবে–
তুই ফুটিবি, সখী কবে॥
প্রাতে পড়েছে, শিশিরকণা, সাঁঝে বহিছে দখিনা বায়,
কাছে ফুলবালা সারি সারি–
দূরে পাতার আড়ালে সাঁঝের তারা মুখানি দেখিতে চায়।
বায়ু দূর হতে আসিয়াছে, যত ভ্রমর ফিরিছে কাছে,
কচি কিশলয়গুলি রয়েছে নয়ন তুলি–
তারা শুধাইছে মিলি সবে,
তুই ফুটিবি, সখী, কবে॥
বসন্ত সে যায় তো হেসে
বসন্ত সে যায় তো হেসে, যাবার কালে
শেষ কুসুমের পরশ রাখে বনের ভালে॥
তেমনি তুমি যাবে জানি, সঙ্গে যাবে হাসিখানি–
অলক হতে পড়বে অশোক বিদায়-থালে
রইব একা ভাসান-খেলার নদীর তটে,
বেদনাহীন মুখের ছবি স্মৃতির পটে–
অবসানের অস্ত-আলো তোমার সাথি, সেই তো ভালো–
ছায়া সে থাক্ মিলনশেষের অন্তরালে॥
বাঁশরি বাজাতে চাহি বাঁশরি বাজিল কই
বাঁশরি বাজাতে চাহি, বাঁশরি বাজিল কই।
বিহরিছে সমীরণ, কুহরিছে পিকগণ,
মথুরার উপবন কুসুমে সাজিল ওই॥
বিকচ বকুলফুল দেখে যে হতেছে ভুল,
কোথাকার অলিকুল গুঞ্জরে কোথায়।
এ নহে কি বৃন্দাবন, কোথা সেই চন্দ্রানন,
ওই কি নুপূরধ্বনি, বনপথে শুনা যায়।
একা আছি বনে বসি, পীত ধড়া পড়ে খসি,
সোঙরি সে মুখশশী পরান মজিল সই॥
একবার রাধে রাধে ডাক্ বাঁশি মনোসাধে–
আজি এ মধুর চাঁদে মধুর যামিনী ভায়।
কোথা সে বিধুরা বালা– মলিনমালতীমালা,
হৃদয়ে বিরহজ্বালা, এ নিশি পোহায় হায়।
কবি যে হল আকুল, একি রে বিধির ভুল,
মথুরায় কেন ফুল ফুটেছে আজি লো সই॥
বাঁশি আমি বাজাই নি কি পথের ধারে ধারে
বাঁশি আমি বাজাই নি কি পথের ধারে ধারে।
গান গাওয়া কি হয় নি সারা তোমার বাহির-দ্বারে॥
ওই-যে দ্বারের যবনিকা নানা বর্ণে চিত্রে লিখা
নানা সুরের অর্ঘ্য হোথায় দিলেম বারে বারে॥
আজ যেন কোন্ শেষের বাণী শুনি জলে স্থলে–
‘পথের বাঁধন ঘুচিয়ে ফেলো’ এই কথা সে বলে।
মিলন-ছোঁওয়া বিচ্ছেদেরই অন্তবিহীন ফেরাফেরি
কাটিয়ে দিয়ে যাও গো নিয়ে আনাগোনার পারে॥
বাজিল কাহার বীণা মধুর স্বরে
বাজিল কাহার বীণা মধুর স্বরে
আমার নিভৃত নব জীবন-‘পরে
প্রভাতকমলসম ফুটিল হৃদয় মম
কার দুটি নিরুপম চরণ-তরে॥
জেগে উঠে সব শোভা, সব মাধুরী,
পলকে পলকে হিয়া পুলকে পূরি।
কোথা হতে সমীরণ আনে নব জাগরণ,
পরানের আবরণ মোচন করে॥
লাগে বুকে সুখে দুখে কত যে ব্যথা,
কেমনে বুঝায়ে কব না জানি কথা।
আমার বাসনা আজি ত্রিভুবনে উঠে বাজি,
কাঁপে নদী বনরাজি বেদনাভরে॥
বাজে করুণ সুরে হায় দূরে
বাজে করুণ সুরে হায় দূরে
তব চরণতলচুম্বিত পন্থবীণা।
এ মম পান্থচিত চঞ্চল
জানি না কী উদ্দেশে॥
যূথীগন্ধ অশান্ত সমীরে
ধায় উতলা উচ্ছ্বাসে,
তেমনি চিত্ত উদাসী রে
নিদারুণ বিচ্ছেদের নিশীথে।
বাণী মোর নাহি
বাণী মোর নাহি,
স্তব্ধ হৃদয় বিছায়ে চাহিতে শুধু জানি॥
আমি অমাবিভাবরী আলোছায়া,
মেলিয়া অগণ্য তারা
নিষ্ফল আশায় নিঃশেষ পথ চাহি॥
তুমি যবে বাজাও বাঁশি সুর আসে ভাসি
নীরবতার গভীরে বিহ্বূল বায়ে
নিদ্রাসমুদ্র পারায়ে।
তোমার সুরের প্রতিধ্বনি তোমারে দিই ফিরায়ে,
কে জানে সে কি পশে তব স্বপ্নের তীরে
বিপুল অন্ধকার বাহি॥
বাহির-পথে বিবাগি হিয়া
বাহির-পথে বিবাগি হিয়া কিসের খোঁজে গেলি,
আয় রে ফিরে আয়।
পুরানো ঘরে দুয়ার দিয়া ছেঁড়া আসন মেলি
বসিবি নিরালায়।
সারাটা বেলা সাগর-ধারে কুড়ালি যত নুড়ি,
নানারঙের শামুক-ভারে বোঝাই হল ঝুড়ি,
লবণপারাবারের পারে প্রখর তাপে পুড়ি
মরিলি পিপাসায়–
ঢেউয়ের দোল তুলিল রোলঅকূলতল জুড়ি,
কহিল বাণী কী জানি কী ভাষায়॥
বিরাম হল আরামহীন যদি রে তোর ঘরে, না যদি রয় সাথি,
সন্ধ্যা যদি তন্দ্রালীন মৌন অনাদরে, না যদি জ্বালে বাতি,
তবু তো আছে আঁধার কোণে ধ্যানের ধনগুলি,
একেলা বসি আপনমনে মুছিবি তার ধূলি,
গাঁথিবি তারে রতনহারে বুকেতে নিবি তুলি মধুর বেদনায়।
কাননবীথি ফুলের রীতি নাহয় গেছে ভুলি,
তারকা আছে গগন-কিনারায়॥
বিজয়মালা এনো আমার লাগি
বিজয়মালা এনো আমার লাগি।
দীর্ঘ রাত্রি রইব আমি জাগি।
চরণ যখন পড়বে তোমার মরণকুলে
বুকের মধ্যে উঠবে আমার পরান দুলে,
সব যদি যায় হব তোমার সর্বনাশের ভাগী।
বিদায় করেছ যারে নয়ন-জলে
বিদায় করেছ যারে নয়ন-জলে,
এখন ফিরাবে তারে কিসের ছলে গো॥
আজি মধু সমীরণে নিশীথে কুসুমবনে
তারে কি পড়েছে মনে বকুলতলে॥
সে দিনও তো মধুনিশি প্রাণে গিয়েছিল মিশি,
মুকুলিত দশ দিশি কুসুমদলে।
দুটি সোহাগের বাণী যদি হত কানাকানি
যদি ঐ মালাখানি পরাতে গলে।
এখন ফিরাবে তারে কিসের ছলে গো
মধুনিশি পূর্ণিমার ফিরে আসে বার বার,
সে জন ফেরে না আর যে গেছে চলে
ছিল তিথি অনকূল, শুধু নিমেষের ভুল–
চিরদিন তৃষাকুল পরান জ্বলে।
এখন ফিরাবে তারে কিসের ছলে গো। ।
বিনা সাজে সাজি দেখা দিবে তুমি কবে
বিনা সাজে সাজি দেখা দিবে তুমি কবে,
আভরণে আজি আবরণ কেন রবে॥
ভালোবাসা যদি মেশে আধা-আধি মোহে
আলোতে আঁধারে দোঁহারে হারাব দোঁহে,
ধেয়ে আসে হিয়া তোমার সহজ রবে,
আভরণ দিয়া আবরণ কেন তবে॥
ভাবের রসেতে যাহার নয়ন ডোবা
ভূষণে তাহারে দেখাও কিসের শোভা।
কাছে এসে তবু কেন রয়ে গেলে দূরে।
বাহির-বাঁধনে বাঁধিবে কি বন্ধুরে।
নিজের ধনে কি নিজে চুরি করে লবে–
আভরণে আজি আবরণ কেন তবে॥]