পূর্ণ প্রাণে চাবার যাহা
পূর্ণ প্রাণে চাবার যাহা রিক্ত হাতে চাস নে তারে,
সিক্তচোখে যাস নে দ্বারে॥
রত্নমালা আনবি যবে মাল্যবদল তখন হবে–
পাতবি কি তোর দেবীর আসন শূন্য ধুলার পথের ধারে॥
বৈশাখে বন রুক্ষ যখন, বহে পবন দৈন্যজ্বালা,
হায় রে তখন শুকনো ফুলে ভরবি কি তোর বরণডালা।
অতিথিরে ডাকবি যবে ডাকিস যেন সগৌরবে,
লক্ষ শিখায় জ্বলবে যখন দীপ্ত প্রদীপ অন্ধকারে॥
প্রভাত-আলোরে মোর কাঁদায়ে গেলে
প্রভাত-আলোরে মোর কাঁদায়ে গেলে
মিলনমালার ডোর ছিঁড়িয়া ফেলে॥
পড়ে যা রহিল পিছে সব হয়ে গেল মিছে,
বসে আছি দূর-পানে নয়ন মেলে॥
একে একে ধূলি হতে কুড়ায়ে মরি
যে ফুল বিদায়পথে পড়িছে ঝরি।
ভাবি নি রবে না লেশ সে দিনের অবশেষ–
কাটিল ফাগুনবেলা কী খেলা খেলে॥
প্রাণ চায় চক্ষু না চায়
প্রাণ চায় চক্ষু না চায়, মরি একি তোর দুস্তরলজ্জা।
সুন্দর এসে ফিরে যায়, তবে কার লাগি মিথ্যা এ সজ্জা॥
মুখে নাহি নিঃসরে ভাষ, দহে অন্তরে নির্বাক বহ্নি।
ওষ্ঠে কী নিষ্ঠুর হাস, তব মর্মে যে ক্রন্দন তন্বী!
মাল্য যে দংশিছে হায়, তব শয্যা যে কণ্টকশয্যা
মিলনসমুদ্রবেলায় চির- বিচ্ছেদজর্জর মজ্জা॥
প্রেমের জোয়ারে ভাসাবে দোঁহারে
প্রেমের জোয়ারে ভাসাবে দোঁহারে– বাঁধন খুলে দাও, দাও দাও দাও।
ভুলিব ভাবনা, পিছনে চাব না,– পাল তুলে দাও, দাও দাও দাও॥
প্রবল পবনে তরঙ্গ তুলিল, হৃদয় দুলিল, দুলিল দুলিল–
পাগল হে নাবিক, ভুলাও দিগ্বিদিক,– পাল তুলে দাও, দাও দাও দাও॥
প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে
প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে,
কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে–
গরব সব হায় কখন টুটে যায়, সলিল বহে যায় নয়নে।
এ সুখ-ধরণীতে কেবলই চাহ নিতে, জান না হবে দিতে আপনা–
সুখের ছায়া ফেলি কখন যাবে চলি, বরিবে সাধ করি বেদনা।
কখন বাজে বাঁশি গরব যায় ভাসি, পরান পড়ে আসি বাঁধনে॥
ফিরবে না তা জানি
ফিরবে না তা জানি, তা জানি–
আহা, তবু তোমার পথ চেয়ে জ্বলুক প্রদীপখানি॥
গাঁথবে না মালা জানি মনে,
আহা, তবু ধরুক মুকুল আমার বকুলবনে
প্রাণে ওই পরশের পিয়াস আনি॥
কোথায় তুমি পথভোলা,
তবু থাক্-না আমার দুয়ার খোলা।
রাত্রি আমার গীতহীনা,
আহা, তবু বাঁধুক সুরে বাঁধুক তোমার বীণা–
তারে ঘিরে ফিরুক কাঙাল বাণী॥
ফিরে ফিরে ডাক্ দেখি রে পরান খুলে
ফিরে ফিরে ডাক্ দেখি রে পরান খুলে, ডাক্ ডাক্ ডাক্ ফিরে ফিরে।
দেখব কেমন রয় সে ভুলে॥
সে ডাক বেড়াক বনে বনে, সে ডাক শুধাক জনে জনে,
সে ডাক বুকে দুঃখে সুখে ফিরুক দুলে॥
সাঁজ-সকালে রাত্রিবেলায় ক্ষণে ক্ষণে
একলা ব’সে ডাক্ দেখি তায় মনে মনে।
নয়ন তোরই ডাকুক তারে, শ্রবণ রহুক পথের ধারে,
থাক্-না সে ডাক গলায় গাঁথা মালার ফুলে॥
ফিরে যাও কেন ফিরে ফিরে যাও
ফিরে যাও কেন ফিরে ফিরে যাও বহিয়া বিফল বাসনা॥
চিরদিন আছ দূরে অজানার মতো নিভৃত অচেনা পুরে,
কাছে আস তবু আস না
বহিয়া বিফল বাসনা॥
পারি না তোমায় বুঝিতে–
ভিতরে কারে কি পেয়েছ, বাহিরে চাহ না খুঁজিতে।
না-বলা তোমার বেদনা যত
বিরহপ্রদীপে শিখার মতো,
নয়নে তোমার উঠেছে জ্বলিয়া
নীরব কী সম্ভাষণা॥
ফুল তুলিতে ভুল করেছি প্রেমের সাধনে
ফুল তুলিতে ভুল করেছি প্রেমের সাধনে।
বঁধু, তোমায় বাঁধব কিসে মধুর বাঁধনে॥
ভোলাব না মায়ার ছলে, রইব তোমার চরণতলে,
মোহের ছায়া ফেলব না মোর হাসি কাঁদনে॥
রইল শুধু বেদন-ভরা আশা, রইল শুধু প্রাণের নীরব ভাষা।
নিরাভরণ যদি থাকি চোখের কোণে চাইবে না কি–
যদি আঁখি নাই-বা ভোলাই রঙের ধাঁদনে॥
বঁধু তোমায় করব রাজা তরুতলে
বঁধু, তোমায় করব রাজা তরুতলে,
বনফুলের বিনোদমালা দেব গলে॥
সিংহাসনে বসাইতে হৃদয়খানি দেব পেতে,
অভিষেক করব তোমায় আঁখিজলে॥
বনে এমন ফুল ফুটেছে
বনে এমন ফুল ফুটেছে,
মান ক’রে থাকা আজ কি সাজে।
মান অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে
চলো চলো কুঞ্জমাঝে॥
আজ কোকিলে গেয়েছে কুহু মুহুর্মুহু,
কাননে ওই বাঁশি বাজে।
মান ক’রে থাকা আজ কি সাজে॥
আজ মধুরে মিশাবি মধু, পরানবঁধু
চাঁদের আলোয় ওই বিরাজে।
মান ক’রে থাকা আজ কি সাজে॥
বনে যদি ফুটল কুসুম
বনে যদি ফুটল কুসুম নেই কেন সেই পাখি।
কোন্ সুদূরের আকাশ হতে আনব তারে ডাকি॥
হাওয়ায় হাওয়ায় মাতন জাগে, পাতায় পাতায় নাচন লাগে গো–
এমন মধুর গানের বেলায় সেই শুধু রয় বাকি॥
উদাস-করা হৃদয়-হরা না জানি কোন্ ডাকে
সাগর-পারের বনের ধারে কে ভুলালো তাকে।
আমার হেথায় ফাগুন বৃথায় বারে বারে ডাকে যে তায় গো–
এমন রাতের ব্যাকুল ব্যথায় কেন সে দেয় ফাঁকি॥
বর্ষণমন্দ্রিত অন্ধকারে এসেছি তোমারি এ দ্বারে
বর্ষণমন্দ্রিত অন্ধকারে এসেছি তোমারি এ দ্বারে,
পথিকেরে লহো ডাকি তব মন্দিরের এক ধারে॥
বনপথ হতে, সুন্দরী, এনেছি মল্লিকামঞ্জলী–
তুমি লবে নিজ বেণীবন্ধে মনে রেখেছি এ দুরাশারে॥
কোনো কথা নাহি ব’লে ধীরে ধীরে ফিরে যাব চলে।
ঝিল্লিঝঙ্কৃত নিশীথে পথে যেতে বাঁশরিতে
শেষ গান পাঠাব তোমা-পানে শেষ উপহারে॥
বলো সখী বলো তারি নাম
বলো সখী, বলো তারি নাম
আমার কানে কানে
যে-নাম বাজে তোমার বীণার
তানে তানে॥
বসন্তবাতাসে বনবীথিকায়
সে-নাম মিলে যাবে,
বিরহীবিহঙ্গকলগীতিকায়
সে নাম মদির হবে যে বকুলঘ্রাণে॥
নাহয় সখীদের মুখে মুখে
সে নাম দোলা খাবে সকৌতুকে।
পূর্ণিমারাতে একা যবে
অকারণে মন উতলা হবে
সে-নাম শুনাইব গানে গানে॥