আকুল কেশে আসে চায় ম্লাননয়নে কে গো চিরবিরহিনী
আকুল কেশে আসে, চায় ম্লাননয়নে, কে গো চিরবিরহিনী–
নিশিভোরে আঁখি জড়িত ঘুমঘোরে,
বিজন ভবনে কুসুমসুরভি মৃদু পবনে,
সুখশয়নে, মম প্রভাতস্বপনে॥
শিহরি চমকি জাগি তার লাগি।
চকিতে মিলায় ছায়াপ্রায়, শুধু রেখে যায়
ব্যাকুল বাসনা কুসুমকাননে॥
আছ আকাশ-পানে তুলে মাথা
আছ আকাশ-পানে তুলে মাথা,
কোলে আধেকখানি মালা গাঁথা ॥
ফাগুনবেলায় বহে আনে আলোর কথা ছায়ার কানে,
তোমার মনে তারি সনে ভাবনা যত ফেরে যা-তা ॥
কাছে থেকে রইলে দূরে,
কায়া মিলায় গানের সুরে।
হারিয়ে-যাওয়া হৃদয় তব মূর্তি ধরে নব নব–
পিয়ালবনে উড়ালো চুল, বকুলবনে আঁচল পাতা ॥
আজ সবার রঙে রঙ মিশাতে হবে
আজ সবার রঙে রঙ মিশাতে হবে।
ওগো আমার প্রিয়, তোমার রঙিন উত্তরীয়
পরো পরো পরো তবে॥
মেঘ রঙে রঙে বোনা, আজ রবির রঙে সোনা,
আজ আলোর রঙ যে বাজল পাখির রবে॥
আজ রঙ-সাগরে তুফান ওঠে মেতে।
যখন তারি হাওয়া লাগে তখন রঙের মাতন জাগে
কাঁচা সবুজ ধানের ক্ষেতে।
সেই রাতের-স্বপন-ভাঙা আমার হৃদয় হোক-না রাঙা
তোমার রঙেরই গৌরবে॥
আজ যেমন ক’রে গাইছে আকাশ
আজ যেমন ক’রে গাইছে আকাশ তেমনি ক’রে গাও গো।
আজ যেমন ক’রে চাইছে আকাশ তেমনি ক’রে চাও গো ॥
আজ হাওয়া যেমন পাতায় পাতায় মর্মরিয়া বনকে কাঁদায়,
তেমনি আমার বুকের মাঝে কাঁদিয়া কাঁদাও গো ॥
আজ তোমারে দেখতে এলেম
আজ তোমারে দেখতে এলেম অনেক দিনের পরে।
ভয় কোরো না, সুখে থাকো, বেশিক্ষণ থাকব নাকো–
এসেছি দণ্ড-দুয়ের তরে॥
দেখব শুধু মুখখানি, শুনাও যদি শুনব বাণী,
নাহয় যাব আড়াল থেকে হাসি দেখে দেশান্তরে॥
আজি যে রজনী যায়
আজি যে রজনী যায় ফিরাইব তায় কেমনে।
নয়নের জল ঝরিছে বিফল নয়নে॥
এ বেশভূষণ লহো সখী, লহো, এ কুসুমমালা হয়েছে অসহ–
এমন যামিনী কাটিল বিরহশয়নে॥
আমি বৃথা অভিসারে এ যমুনাপারে এসেছি,
বহি বৃথা মন-আশা এত ভালোবাসা বেসেছি।
শেষে নিশিশেষে বদন মলিন, ক্লান্তচরণ, মন উদাসীন,
ফিরিয়া চলেছি কোন্ সুখহীন ভবনে॥
ওগো ভোলা ভালো তবে, কাঁদিয়া কী হবে মিছে আর।
যদি যেতে হল হায় প্রাণ কেন চায় পিছে আর।
কুঞ্জদুয়ারে অবোধের মতো রজনীপ্রভাতে বসে রব কত–
এবারের মতো বসন্ত গত জীবনে॥
আজি সাঁঝের যমুনায় গো
আজি সাঁঝের যমুনায় গো
তরুণ চাঁদের কিরণতরী কোথায় ভেসে যায় গো ॥
তারি সুদূর সারিগানে বিদায়স্মৃতি জাগায় প্রাণে
সেই-যে দুটি উতল আঁখি উছল করুণায় গো ॥
আজ মনে মোর যে সুর বাজে কেউ তা শোনে না কি।
একলা প্রাণের কথা নিয়ে একলা এ দিন যায় কি।
যায় যাবে, সে ফিরে ফিরে লুকিয়ে তুলে নেয় নি কি রে
আমার পরম বেদনখানি আপন বেদনায় গো ॥
আজি গোধূলিলগনে এই বাদলগগনে
আজি গোধূলিলগনে এই বাদলগগনে
তার চরণধ্বনি আমি হৃদয়ে গণি–
‘সে আসিবে’ আমার মন বলে সারাবেলা,
অকারণ পুলকে আঁখি ভাসে জলে॥
অধীর পবনে তার উত্তরীয় দূরের পরশন দিল কি ও
রজনীগন্ধার পরিমলে ‘সে আসিবে’ আমার মন বলে।
উতলা হয়েছে মালতীর লতা, ফুরালো না তাহার মনের কথা।
বনে বনে আজি একি কানাকানি,
কিসের বারতা ওরা পেয়েছে না জানি,
কাঁপন লাগে দিগঙ্গনার বুকের আঁচলে–
‘সে আসিবে’ আমার মন বলে॥
আজি আঁখি জুড়ালো হেরিয়ে
আজি আঁখি জুড়ালো হেরিয়ে,
আহা আঁখি জুড়ালো হেরিয়ে মনোমোহন, মিলনমাধুরী যুগলমুরতি।
ফুলগন্ধে আকুল করে, বাজে বাঁশরি উদাস স্বরে,
নিকুঞ্জ প্লাবিত চন্দ্রকরে–
তারি মাঝে মনোমোহন মিলনমাধুরী, যুগলমুরতি॥
আনো আনো ফুলমালা, দাও দোঁহে বাঁধিয়ে।
হৃদয়ে পশিবে ফুলপাশ, অক্ষয় হবে প্রেমবন্ধন।
চিরদিন হেরিব হে মনোমোহন মিলনমাধুরী, যুগলমুরতি॥
আজি এ নিরালা কুঞ্জে আমার অঙ্গ-মাঝে
আজি এ নিরালা কুঞ্জে আমার অঙ্গ-মাঝে
বরণের ডালা সেজেছে আলোকমালার সাজে॥
নব বসন্তে লতায় লতায় পাতায় ফুলে
বাণীহিল্লোল উঠে প্রভাতের স্বর্ণকূলে,
আমার দেহের বাণীতে সে গান উঠিছে দুলে–
এ বরণগান নাহি পেলে মান মরিব লাজে।
ওহে প্রিয়তম, দেহে মনে মম ছন্দ বাজে॥
অর্ঘ্য তোমার আনি নি ভরিয়া বাহির হতে,
ভেসে আসে পূজা পূর্ণ প্রাণের আপন স্রোতে।
মোর তনুময় উছলে হৃদয় বাঁধনহারা,
অধীরতা তারি মিলনে তোমারি হোক-না সারা।
ঘন যামিনীর আঁধারে যেমন জ্বলিছে তারা,
দেহ ঘেরি মম প্রাণের চমক তেমনি রাজে–
সচকিত আলো নেচে উঠে মোর সকল কাজে॥
আজি দক্ষিণপবনে দোলা লাগিল বনে বনে
আজি দক্ষিণপবনে
দোলা লাগিল বনে বনে॥
দিক্ললনার নৃত্যচঞ্চল মঞ্জীরধ্বনি অন্তরে ওঠে রনরনি
বিরহবিহ্বল হৃৎস্পন্দনে॥
মাধবীলতায় ভাষাহারা ব্যাকুলতা
পল্লবে পল্লবে প্রলপিত কলরবে।
প্রজাপতির পাখায় দিকে দিকে লিপি নিয়ে যায়
উৎসব-আমন্ত্রণে॥
আন্মনা আন্মনা
আন্মনা, আন্মনা,
তোমার কাছে আমার বাণীর মাল্যখানি আনব না।
বার্তা আমার ব্যর্থ হবে, সত্য আমার বুঝবে কবে,
তোমারো মন জানব না, আন্মনা আন্মনা ॥
লগ্ন যদি হয় অনুকূল মৌনমধুর সাঁঝে,
নয়ন তোমার মগ্ন যখন ম্লান আলোর মাঝে,
দেব তোমায় শান্ত সুরের সান্ত্বনা ॥
ছন্দে গাঁথা বাণী তখন পড়ব তোমার কানে
মন্দ মৃদুল তানে,
ঝিল্লি যেমন শালের বনে নিদ্রানীরব রাতে
অন্ধকারের জপের মালায় একটানা সুর গাঁথে,
একলা তোমার বিজন প্রাণের প্রাঙ্গণে
প্রান্তে বসে একমনে
এঁকে যাব আমার গানের আল্পনা,
আন্মনা, আন্মনা ॥