জাগরণে যায় বিভাবরী
জাগরণে যায় বিভাবরী–
আঁখি হতে ঘুম নিল হরি মরি মরি॥
যার লাগি ফিরি একা একা– আঁখি পিপাসিত, নাহি দেখা,
তারি বাঁশি ওগো তারি বাঁশি তারি বাঁশি বাজে হিয়া ভরি মরি মরি॥
বাণী নাহি, তবু কানে কানে কী যে শুনি তাহা কেবা জানে।
এই হিয়াভরা বেদনাতে, বারি-ছলোছলো আঁখিপাতে,
ছায়া দোলে তারি ছায়া দোলে ছায়া দোলে দিবানিশি ধরি মরি মরি॥
জানি তোমার অজানা নাহি গো
জানি তোমার অজানা নাহি গো কী আছে আমার মনে।
আমি গোপন করিতে চাহি গো, ধরা পড়ে দুনয়নে॥
কী বলিতে পাছে কি বলি
তাই দূরে চলে যাই কেবলই,
পথপাশে দিন বাহি গো–
তুমি দেখে যাও আঁখিকোণে কী আছে আমার মনে॥
চিরনিশীথতিমির গহনে আছে মোর পূজাবেদী–
চকিত হাসির দহনে সে তিমির দাও ভেদি।
বিজন দিবস-রাতিয়া
কাটে ধেয়ানের মালা গাঁথিয়া,
আনমনে গান গাহি গো–
তুমি শুনে যাও খনে খনে কী আছে আমার মনে॥
জানি জানি হল যাবার আয়োজন
জানি, জানি হল যাবার আয়োজন–
তবু, পথিক, থামো থামো কিছুক্ষণ।
শ্রাবণগগন বারি-ঝরা,
কাননবীথি ছায়ায় ভরা,
শুনি জলের ঝরোঝরে যূথীবনের ফুল-ঝরা ক্রন্দন॥
যেয়ো– যখন বাদলশেষের পাখি
পথে পথে উঠবে ডাকি ডাকি।
শিউলিবনের মধুর স্তবে
জাগবে শরৎলক্ষ্ণী যবে,
শুভ্র আলোর শঙ্খরবে পরবে ভালে মঙ্গলচন্দন॥
জানি জানি তুমি এসেছ এ পথে মনের ভুলে
জানি জানি তুমি এসেছ এ পথে মনের ভুলে।
তাই হোক তবে তাই হোক, দ্বার দিলেম খুলে॥
এসছে তুমি তো বিনা আভরণে, মুখর নূপুর বাজে না চরণে,
তাই হোক তবে তাই হোক, এসো সহজ মনে।
ওই তো মালতী ঝরে পড়ে যায় মোর আঙিনায়,
শিথিল কবরী সাজাতে তোমার লও-না তুলে॥
কোনো আয়োজন নাই একেবারে, সুর বাঁধা নাই এ বীণার তারে,
তাই হোক তবে, এসো হৃদয়ের মৌনপারে।
ঝরোঝরো বারি ঝরে বনমাঝে, আমার মনের সুর ওই বাজে,
উতলা হাওয়ার তালে তালে মন উঠিছে দুলে॥
জানি তুমি ফিরে আসিবে আবার
জানি তুমি ফিরে আসিবে আবার, জানি।
তবু মনে মনে প্রবোধ নাহি যে মানি॥
বিদায়লগনে ধরিয়া দুয়ার তাই তো তোমায় বলি বারবার
‘ফিরে এসো এসো বন্ধু আমার’, বাষ্পবিভল বাণী॥
যাবার বেলায় কিছু মোরে দিয়ো দিয়ো
গানের সুরেতে তব আশ্বাস প্রিয়।
বনপথে যবে যাবে সে ক্ষণের হয়তো বা কিছু রবে স্মরণের
তুলি লব সেই তব চরণের দলিত কুসুমখানি॥
জীবনে আজ কি প্রথম এল বসন্ত
জীবনে আজ কি প্রথম এল বসন্ত।
নবীনবাসনাভরে হৃদয় কেমন করে,
নবীন জীবনে হল জীবন্ত।
সুখভরা এ ধরায় মন বাহিরিতে চায়,
কাহারে বসাতে চায় হৃদয়ে।
তাহারে খুঁজিব দিকদিগন্ত॥
যেমন দখিনে বায়ু ছুটেছে, না জানি কোথায় ফুল ফুটেছে,
তেমনি আমিও, সখী যাব– না জানি কোথায় দেখা পাব।
কার সুধাস্বর-মাঝে, জগতের গীত বাজে,
প্রভাত জাগিছে কার নয়নে,
কাহার প্রাণের প্রেম অনন্ত
তাহারে খুঁজিব দিকদিগন্ত॥
জীবনে পরম লগন কোরো না হেলা
জীবনে পরম লগন কোরো না হেলা
কোরো না হেলা হে গরবিনি।
বৃথাই কাটিবে বেলা, সাঙ্গ হবে যে খেলা,
সুধার হাটে ফুরাবে বিকিকিনি হে গরবিনি॥
মনের মানুষ লুকিয়ে আসে, দাঁড়ায় পাশে, হায়
হেসে চলে যায় জোয়ারজলে ভাসিয়ে ভেলা–
দুর্লভ ধনে দুঃখের পণে লও গো জিনি, হে গরবিনি॥
ফাগুন যখন যাবে গো নিয়ে ফুলের ডালা
কী দিয়ে তখন গাঁথিবে তোমার বরণমালা।
হে বিরহিণী।
বাজবে বাঁশি দূরের হাওয়ায়,
চোখের জলে শূন্যে চাওয়ায় কাটবে প্রহর–
বাজবে বুকে বিদায়পথে চরণ-ফেলা দিনযামিনী,
হে গরবিনি॥
জেনো প্রেম চিরঋণী আপনারি হরষে
জেনো প্রেম চিরঋণী আপনারি হরষে, জেনো প্রিয়ে
সব পাপ ক্ষমা করি ঋণশোধ করে সে।
কলঙ্ক যাহা আছে দূর হয় তার কাছে,
কালিমার ‘পরে তার অমৃত সে বরষে॥
জয় ক’রে তবু ভয় কেন তোর যায় না
জয় ক’রে তবু ভয় কেন তোর যায় না,
হায় ভীরু প্রেম, হায় রে।
আশার আলোয় তবুও ভরসা পায় না,
মুখে হাসি তবু চোখে জল না শুকায় রে॥
বিরহের দাহ আজি হল যদি সারা,
ঝরিল মিলনরসের শ্রাবণধারা,
তবুও এমন গোপন বেদনতাপে
অকারণ দুখে পরান কেন দুখায় রে॥
যদিবা ভেঙেছে ক্ষণিক মোহের ভুল,
এখনো প্রাণে কি যাবে না মানের মূল।
যাহা খুঁজিবার সাঙ্গ হল তো খোঁজা,
যাহা বুঝিবার শেষ হয়ে গেল বোঝা,
তবু কেন হেন সংশয়ঘনছায়ে
মনের কথাটি নীরব মনে লুকায় রে॥
জয়যাত্রায় যাও গো ওঠো জয়রথে তব
জয়যাত্রায় যাও গো, ওঠো জয়রথে তব।
মোরা জয়মালা গেঁথে আশা চেয়ে বসে রব॥
মোরা আঁচল বিছায়ে রাখি পথধুলা দিব ঢাকি,
ফিরে এলে হে বিজয়ী,
তোমায় হৃদয়ে বরিয়া লব॥
আঁকিয়ো হাসির রেখা সজল আঁখির কোণে,
নব বসন্তশোভা এনো এ কুঞ্জবনে।
তোমার সোনার প্রদীপে জ্বালো
আঁধার ঘরের আলো,
পরাও রাতের ভালে চাঁদের তিলক নব॥
ঝড়ে যায় উড়ে যায় গো
ঝড়ে যায় উড়ে যায় গো আমার মুখের আঁচলখানি।
ঢাকা থাকে না হায় গো, তারে রাখতে নারি টানি॥
আমার রইল না লাজলজ্জা, আমার ঘুচল গো সাজসজ্জা–
তুমি দেখলে আমারে এমন প্রলয়-মাঝে আনি
আমায় এমন মরণ হানি॥
হঠাৎ আকাশ উজলি কারে খুঁজে কে ওই চলে,
চমক লাগায় বিজুলি আমার আঁধার ঘরের তলে।
তবে নিশীথগগন জুড়ে আমার যাক সকলই উড়ে,
এই দারুণ কল্লোলে বাজুক আমার প্রাণের বাণী
কোনো বাঁধন নাহি মানি॥