কোন্ গহন অরণ্যে তারে এলেম হারায়ে
কোন্ গহন অরণ্যে তারে এলেম হারায়ে
কোন্ দূর জনমের কোন্ স্মৃতিবিস্মৃতিছায়ে॥
আজ আলো-আঁধারে
কখন্-বুঝি দেখি, কখন্ দেখি না তারে–
কোন্ মিলনসুখের স্বপনসাগর এল পারায়ে॥
ধরা-অধরার মাঝে
ছায়ানটের রাগিণীতে আমার বাঁশি বাজে।
বকুলতলায় ছায়ার নাচন ফুলের গন্ধে মিশে
জানি নে মন পাগল করে কিসে।
কোন্ নটিনীর ঘূর্ণি-আঁচল লাগে আমার গায়ে॥
কোন্ অযাচিত আশার আলো
কোন্ অযাচিত আশার আলো
দেখা দিল রে তিমিররাত্রি ভেদি দুর্দিনদুর্যোগে–
কাহার মাধুরী বাজাইল করুণ বাঁশি।
অচেনা নির্মম ভুবনে দেখিনু একি সহসা–
কোন্ অজানার সুন্দর মুখে সান্ত্বনাহাসি॥
কোন্ দেবতা সে
কোন্ দেবতা সে, কী পরিহাসে ভাসালো মায়ার ভেলায়।
স্বপ্নের সাথি, এসো মোরা মাতি স্বর্গের কৌতুক-খেলায়॥
সুরের প্রবাহে হাসির তরঙ্গে বাতাসে বাতাসে ভেসে যাব রঙ্গে
নৃত্যবিভঙ্গে
মাধবীবনের মধুগন্ধে মোদিত মোহিত মন্থর বেলায়॥
যে ফুলমালা দুলায়েছ আজি রোমাঞ্চিত বক্ষতলে
মধুরজনীতে রেখো সরসিয়া মোহের মদির জলে।
নবোদিত সূর্যের করসম্পাতে বিকল হবে হায় লজ্জা-আঘাতে,
দিন গত হলে নূতন প্রভাতে মিলাবে ধুলার তলে কার অবহেলায়॥
কোন্ বাঁধনের গ্রন্থি বাঁধিল দুই অজানারে
কোন্ বাঁধনের গ্রন্থি বাঁধিল দুই অজানারে
এ কী সংশয়েরি অন্ধকারে।
দিশেহারা হাওয়ায় তরঙ্গদোলায়
মিলনতরণীখানি ধায় রে
কোন্ বিচ্ছেদের পারে॥
কোন্ সে ঝড়ের ভুল ঝরিয়ে দিল ফুল
কোন্ সে ঝড়ের ভুল
ঝরিয়ে দিল ফুল,
প্রথম যেমনি তরুণ মাধুরী মেলেছিল এ মুকুল, হায় রে॥
নব প্রভাতের তারা
সন্ধ্যাবেলায় হয়েছে পথহারা।
অমরাবতীর সুরযুবতীর এ ছিল কানের দুল, হায় রে॥
এ যে মুকুটশোভার ধন।
হায় গো দরদী কেহ থাক যদি শিরে দাও পরশন।
এ কি স্রোতে যাবে ভেসে– দূর দয়াহীন দেশে
কোন্খানে পাবে কূল, হায় রে॥
ক্লান্ত বাঁশির শেষ রাগিণী বাজে শেষের রাতে
ক্লান্ত বাঁশির শেষ রাগিণী বাজে শেষের রাতে
শুকনো ফুলের মালা এখন দাও তুলে মোর হাতে।
সুরখানি ওই নিয়ে কানে পাল তুলে দিই পারের পানে,
চৈত্ররাতের মলিন মালা রইবে আমার সাথে॥
পথিক আমি এসেছিলেম তোমার বকুলতলে–
পথ আমারে ডাক দিয়েছে, এখন যাব চলে।
ঝরা যূথীর পাতায় ঢেকে আমার বেদন গেলেম রেখে,
কোন্ ফাগুনে মিলবে সে-যে তোমার বেদনাতে॥
খোলো খোলো দ্বার রাখিয়ো না আর
খোলো খোলো দ্বার, রাখিয়ো না আর
বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে।
দাও সাড়া দাও, এই দিকে চাও
এসো দুই বাহু বাড়ায়ে॥
কাজ হয়ে গেছে সারা, উঠেছে সন্ধ্যাতারা,
আলোকের খেয়া হয়ে গেল দেয়া
অস্তসাগর পারায়ে॥
ভরি লয়ে ঝারি এনেছি তো বারি
সেজেছি তো শুচি দুকূলে,
বেঁধেছি তো চুল, তুলেছি তো ফুল
গেঁথেছি তো মালা মুকুলে।
ধেনু এল গোঠে ফিরে, পাখিরা এসেছে নীড়ে,
পথ ছিল যত জুড়িয়া জগত
আঁধারে গিয়েছে হারায়ে॥
গহন ঘন বনে পিয়াল-তমাল-সহকার-ছায়ে
গহন ঘন বনে পিয়াল-তমাল-সহকার-ছায়ে
সন্ধ্যাবায়ে তৃণশয়নে মুগ্ধনয়নে রয়েছি বসি॥
শ্যামল পল্লবভার আঁধারে মর্মরিছে,
বায়ুভরে কাঁপে শাখা, বকুলদল পড়ে খসি॥
স্তব্ধ নীড়ে নীরব বিহগ,
নিস্তরঙ্গ নদীপ্রান্তে অরণ্যের নিবিড় ছায়া।
ঝিল্লিমন্দ্রে তন্দ্রাপূর্ণ জলস্থল শূন্যতল,
চরাচরে স্বপনের মায়া।
নির্জন হৃদয়ে মোর জাগিতেছে সেই মুখশশী॥
গান আমার যায় ভেসে যায়
গান আমার যায় ভেসে যায়—-
চাস্ নে ফিরে, দে তারে বিদায়॥
সে যে দখিনহাওয়ায় মুকুল ঝরা, ধুলার আঁচল হেলায় ভরা,
সে যে শিশির-ফোঁটার মালা গাঁথা বনের আঙিনায়॥
কাঁদন-হাসির আলোছায়া সারা অলস বেলা–
মেঘের গায়ে রঙের মায়া, খেলার পরে খেলা।
ভুলে-যাওয়ার বোঝাই ভরি গেল চলে কতই তরী–
উজান বায়ে ফেরে যদি কে রয় সে আশায়॥
গানগুলি মোর শৈবালেরই দল
গানগুলি মোর শৈবালেরই দল–
ওরা বন্যাধারায় পথ যে হারায়
উদ্দাম চঞ্চল॥
ওরা কেনই আসে যায় বা চ’লে, অকারণের হাওয়ায় দোলে–
চিহ্ন কিছুই যায় না রেখে, পায় না কোনো ফল॥
ওদের সাধন তো নাই– কিছু সাধন তো নাই,
ওদের বাঁধন তো নাই– কোনো বাঁধন তো নাই।
উদাস ওরা উদাস করে গৃহহারা পথের স্বরে,
ভুলে-যাওয়ার স্রোতের ‘পরে করে টলোমল।
গানের ডালি ভরে দে গো উষার কোলে
গানের ডালি ভরে দে গো উষার কোলে–
আয় গো তোরা, আয় গো তোরা, আয় গো চলে ॥
চাঁপার কলি চাঁপার গাছে সুরের আশায় চেয়ে আছে,
কান পেতেছে নতুন পাতা গাইবি ব’লে ॥
কমলবরণ গগন-মাঝে
কমলচরণ ওই বিরাজে
ওইখানে তোর সুর ভেসে যাক, নবীন প্রাণের ওই দেশে যাক,
ওই যেখানে সোনার আলোর দুয়ার খোলে ॥
গানের ভেলায় বেলা অবেলায় প্রাণের আশা
গানের ভেলায় বেলা অবেলায় প্রাণের আশা
ভোলা মনের স্রোতে ভাসা ॥
কোথায় জানি ধায় সে বাণী, দিনের শেষে
কোন ঘাটে যে ঠেকে এসে চিরকালের কাঁদা-হাসা ॥
এমনি খেলার ঢেউয়ের দোলে
খেলার পারে যাবি চলে।
পালের হাওয়ার ভরসা তোমার– করিস নে ভয়
পথের কড়ি না যদি রয়, সঙ্গে আছে বাঁধন-নাশা ॥
গেল গো ফিরিল না
গেল গো–
ফিরিল না, চাহিল না, পাষাণ সে।
কথাটিও কহিল না, চলে গেল গো ॥
না যদি থাকিতে চায় যাক যেথা সাধ যায়,
একেলা আপন-মনে দিন কি কাটিবে না।
তাই হোক, হোক তবে–
আর তারে সাধিব না ॥