কে বলেছে তোমায়, বঁধু এত দুঃখ সইতে
কে বলেছে তোমায়, বঁধু, এত দুঃখ সইতে।
আপনি কেন এলে, বঁধু, আমার বোঝা বইতে॥
প্রাণের বন্ধু, বুকের বন্ধু,
সুখের বন্ধু, দুখের বন্ধু,
তোমায় দেব না দুখ পাব না দুখ,
হেরব তোমার প্রসন্ন মুখ,
আমি সুখে দুঃখে পারব বন্ধু চিরানন্দে রইতে–
তোমার সঙ্গে বিনা কথায় মনের কথা কইতে॥
কেটেছে একেলা বিরহের বেলা আকাশকুসুমচয়নে
কেটেছে একেলা বিরহের বেলা আকাশকুসুমচয়নে।
সব পথ এসে মিলে গেল শেষে তোমার দুখানি নয়নে॥
দেখিতে দেখিতে নূতন আলোকে কি দিল রচিয়া ধ্যানের পুলকে
নূতন ভুবন নূতন দ্যুলোকে মোদের মিলিত নয়নে॥
বাহির-আকাশে মেঘ ঘিরে আসে, এল সব তারা ঢাকিতে।
হারানো সে আলো আসন বিছালো শুধু দুজনের আঁখিতে।
ভাষাহারা মম বিজন রোদনা প্রকাশের লাগি করেছে সাধনা,
চিরজীবনেরি বাণীর বেদনা মিটিল দোঁহার নয়নে॥
কেন নয়ন আপনি ভেসে যায় জলে
কেন নয়ন আপনি ভেসে যায় জলে।
কেন মন কেন এমন করে॥
যেন সহসা কী কথা মনে পড়ে–
মনে পড়ে না গো তবু মনে পড়ে॥
চারি দিকে সব মধুর নীরব,
কেন আমারি পরান কেঁদে মরে।
কেন মন কেন এমন কেন রে॥
যেন কাহার বচন দিয়েছে বেদন,
যেন কে ফিরে গিয়েছে অনাদরে–
বাজে তারি অযতন প্রাণের ‘পরে।
যেন সহসা কী কথা মনে পড়ে–
মনে পড়ে না গো তবু মনে পড়ে॥
কেন যামিনী না যেতে জাগালে না
কেন যামিনী না যেতে জাগালে না, বেলা হল মরি লাজে।
শরমে জড়িত চরণে কেমনে চলিব পথেরি মাঝে।
আলোকপরশে মরমে মরিয়া হেরো গো শেফালি পড়িছে ঝরিয়া,
কোনোমতে আছে পরান ধরিয়া কামিনী শিথিল সাজে॥
নিবিয়া বাঁচিল নিশার প্রদীপ উষার বাতাস লাগি,
রজনীর শশী গগনের কোণে লুকায় শরণ মাগি।
পাখি ডাকি বলে ‘গেল বিভাবরী’, বধূ চলে জলে লইয়া গাগরি।
আমি এ আকুল কবরী আবরি কেমনে যাইব কাজে॥
কেন আমায় পাগল করে যায়
কেন আমায় পাগল করে যায় ওরে চলে-যাওয়ার দল।
আকাশে বয় বাতাস উদাস, পরান টলোমল॥
প্রভাততারা দিশাহারা, শরতমেঘের ক্ষণিক ধারা–
সভা ভাঙার শেষ বীণাতে তাল লাগে চঞ্চল॥
নাগকেশরের ঝরা কেশর ধুলার সাথে মিতা।
গোধুলি সে রক্ত-আলোয় জ্বালে আপন চিতা।
শীতের হাওয়ায় ঝরায় পাতা, আম্লকী-বন মরণ-মাতা,
বিদায়বাঁশির সুরে বিধুর সাঁজের দিগঞ্চল॥
কেন ধরে রাখা ও যে যাবে চলে
কেন ধরে রাখা, ও যে যাবে চলে
মিলনযামিনী গত হলে॥
স্বপনশেষে নয়ন মেলো, নিব-নিব দীপ নিবায়ে ফেলো–
কী হবে শুকানো ফুলদলে॥
জাগে শুকতারা, ডাকিছে পাখি,
উষা সকরুণ অরুণ-আঁখি।
এসো প্রাণপণ হাসিমুখে বলো ‘যাও সখা! থাকো সুখে’–
ডেকো না, রেখো না আঁখিজলে॥
কেন বাজাও কাঁকন কনকন কত ছলভরে
কেন বাজাও কাঁকন কনকন কত ছলভরে।
ওগো, ঘরে ফিরে চলো কনককলসে জল ভরে॥
কেন জলে ঢেউ তুলি ছলকি ছলকি করে খেলা।
কেন চাহ খনে খনে চকিত নয়নে কার তরে কত ছলভরে॥
হেরো যমুনা-বেলায় আলসে হেলায় গেল বেলা,
যত হাসিভরা ঢেউ করে কানাকানি কলস্বরে কত ছলভরে।
হেরো নদীপরপারে গগনকিনারে মেঘমেলা,
তারা হাসিয়া হাসিয়া চাহিছে তোমারি মুখ’পরে কত ছলভরে॥
কেন রে এতই যাবার ত্বরা
কেন রে এতই যাবার ত্বরা–
বসন্ত, তোর হয়েছে কি ভোর গানের ভরা ॥
এখনি মাধবী ফুরালো কি সবই,
বনছায়া গায় শেষ ভৈরবী–
নিল কি বিদায় শিথিল করবী বৃন্তঝরা ॥
এখনি তোমার পীত উত্তরী দিবে কি ফেলে
তপ্ত দিনের শুষ্ক তৃণের আসন মেলে।
বিদায়ের পথে হতাশ বকুল
কপোতকূজনে হল যে আকুল,
চরণপূজনে ঝরাইছে ফুল বসুন্ধরা ॥
কেন সারা দিন ধীরে ধীরে
কেন সারা দিন ধীরে ধীরে
বালু নিয়ে শুধু খেলো তীরে॥
চলে গেল বেলা, রেখে মিছে খেলা
ঝাঁপ দিয়ে পড়ো কালো নীরে।
অকূল ছানিয়ে যা পাও তা নিয়ে
হেসে কেঁদে চলো ঘরে ফিরে॥
নাহি জানি মনে কী বাসিয়া
পথে বসে আছে কে আসিয়া।
কী কুসুমবাসে ফাগুনবাতাসে
হৃদয় দিতেছে উদাসিয়া।
চল্ ওরে এই খ্যাপা বাতাসেই
সাথে নিয়ে সেই উদাসীরে॥
কেহ কারো মন বুঝে না
কেহ কারো মন বুঝে না, কাছে এসে সরে যায়।
সোহাগের হাসিটি কেন চোখের জলে মরে যায়॥
বাতাস যখন কেঁদে গেল প্রাণ খুলে ফুল ফুটিল না,
সাঁঝের বেলা একাকিনী কেন রে ফুল ঝরে যায়॥
মুখের পানে চেয়ে দেখো, আঁখিতে মিলাও আঁখি–
মধুর প্রাণের কথা প্রাণেতে রেখো না ঢাকি।
এ রজনী রহিবে না, আর কথা হইবে না–
প্রভাতে রহিবে শুধু হৃদয়ের হায়-হায়॥
কোথা বাইরে দূরে যায় রে উড়ে
কোথা বাইরে দূরে যায় রে উড়ে হায় রে হায়,
তোমার চপল আঁখি বনের পাখি বনে পালায়॥
ওগো, হৃদয়ে যবে মোহন রবে বাজবে বাঁশি
তখন আপনি সেধে ফিরবে কেঁদে, পরবে ফাঁসি–
তখন ঘুচবে ত্বরা, ঘুরিয়া মরা হেথা হোথায়।
আহা, আজি সে আঁখি বনের পাখি বনে পালায়॥
চেয়ে দেখিস না রে হৃদয়দ্বারে কে আসে যায়,
তোরা শুনিস কানে বারতা আনে দখিন বায়।
আজি ফুলের বাসে সুখের হাসে আকুল গানে
চির বসন্ত যে তোমারি খোঁজে এসেছে প্রাণে,
তারে বাহিরে খুঁজি ফিরিছ বুঝি পাগলপ্রায়–
আহা আজি সে আঁখি বনের পাখি বনে পালায়॥
কোথা হতে শুনতে যেন পাই
কোথা হতে শুনতে যেন পাই–,
আকাশে আকাশে বলে ‘যাই’॥
পাতায় পাতায় ঘাসে ঘাসে জেগে ওঠে দীর্ঘশ্বাসে
‘হায়, তারা নাই, তারা নাই’॥
কত দিনের কত ব্যথা হাওয়ায় ছড়ায় ব্যাকুলতা।
চলে যাওয়ার পথ যে দিকে সে দিক-পানে অনিমিখে
আজ ফিরে চাই, ফিরে চাই॥