কাহার গলায় পরাবি গানের রতনহার
কাহার গলায় পরাবি গানের রতনহার,
তাই কি বীণায় লাগালি যতনে নূতন তার ॥
কানন পরেছে শ্যামল দুকূল, আমের শাখাতে নূতন মুকুল,
নবীনের মায়া করিল আকুল হিয়া তোমার ॥
যে কথা তোমার কোনো দিন আর হয় নি বলা
নাহি জানি কারে তাই বলিবারে করে উতলা!
দখিনপবনে বিহ্বলা ধরা কাকলিকূজনে হয়েছে মুখরা,
আজি নিখিলের বাণীমন্দিরে খুলেছে দ্বার ॥
কী ফুল ঝরিল বিপুল অন্ধকারে
কী ফুল ঝরিল বিপুল অন্ধকারে।
গন্ধ ছড়ালো ঘুমের প্রান্তপারে॥
একা এসেছিল ভুলে অন্ধরাতের কূলে
অরুণ-আলোর বন্দনা করিবারে।
ক্ষীণ দেহে মরি মরি সে যে নিয়েছিল বরি
অসীম সাহসে নিষ্ফল সাধনারে॥
কী যে তার রূপ দেখা হল না তো চোখে,
জানি না কী নামে স্মরণ করিব ওকে।
আঁধারে যাহারা চলে সেই তারাদের দলে
এসে ফিরে গেল বিরহের ধারে ধারে।
করুণ মাধুরীখানি কহিতে জানে না বাণী
কেন এসেছিল রাতের বন্ধ দ্বারে॥
কী রাগিণী বাজালে হৃদয়ে
কী রাগিণী বাজালে হৃদয়ে, মোহন, মনোমোহন,
তাহা তুমি জান হে, তুমি জান॥
চাহিলে মুখপানে, কী গাহিলে নীরবে
কিসে মোহিলে মন প্রাণ,
তাহা তুমি জান হে, তুমি জান॥
আমি শুনি দিবারজনী
তারি ধ্বনি, তারি প্রতিধ্বনি।
তুমি কেমনে মরম পরশিলে মম,
কোথা হতে প্রাণ কেড়ে আন,
তাহা তুমি জান হে, তুমি জান॥
কী সুর বাজে আমার প্রাণে
কী সুর বাজে আমার প্রাণে আমিই জানি, মনই জানে॥
কিসের লাগি সদাই জাগি, কাহার কাছে কী ধন মাগি–
তাকাই কেন পথের পানে॥
দ্বারের পাশে প্রভাত আসে, সন্ধ্যা নামে বনের বাসে।
সকাল-সাঁঝে বাঁশি বাজে, বিকল করে সকল কাজে–
বাজায় কে যে কিসের তানে॥
কী হল আমার বুঝি বা সখী
কী হল আমার! বুঝি বা সখী, হৃদয় আমার হারিয়েছি।
পথের মাঝেতে খেলাতে গিয়ে হৃদয় আমার হারিয়েছি॥
প্রভাতকিরণে সকালবেলাতে
মন লয়ে, সখী, গেছিনু খেলাতে–
মন কুড়াইতে, মন ছড়াইতে, মনের মাঝারে খেলি বেড়াইতে,
মনোফুল দলি চলি বেড়াইতে–
সহসা, সজনী, চেতনা পেয়ে
সহসা, সজনী, দেখিনু চেয়ে
রাশি রাশি ভাঙা হৃদয়-মাঝে হৃদয় আমার হারিয়েছি॥
যদি কেহ, সখী, দলিয়া যায়,
তার ‘পর দিয়া চলিয়া যায়–
শুকায়ে পড়িবে, ছিঁড়িয়া পড়িবে, দলগুলি তার ঝরিয়া পড়িবে–
যদি কেহ, সখী, দলিয়া যায়।
আমার কুসুমকোমল হৃদয় কখনো সহে নি রবির কর,
আমার মনের কামিনীপাপড়ি সহে নি ভ্রমরচরণভর।
চিরদিন, সখী, হাসিত খেলিত,
জোছনা-আলোকে নয়ন মেলিত–
সহসা আজ সে হৃদয় আমার কোথায়, সজনী, হারিয়েছি॥
কে আমারে যেন এনেছে ডাকিয়া
কে আমারে যেন এনেছে ডাকিয়া, এসেছি ভুলে।
তবু একবার চাও মুখপানে নয়ন তুলে।
দেখি ও নয়নে নিমেষের তরে সে দিনের ছায়া পড়ে কি না পড়ে,
সজল আবেগে আঁখিপাতা-দুটি পড়ে কি ঢুলে।
ক্ষণেকের তরে ভুল ভাঙায়ো না, এসেছি ভুলে।
ব্যথা দিয়ে কবে কথা কয়েছিলে পড়ে না মনে,
দূরে থেকে কবে ফিরে গিয়েছিলে নাই স্মরণে।
শুধু মনে পড়ে হাসিমুখখানি, লাজে বাধো-বাধো সোহাগের বাণী,
মনে পড়ে সেই হৃদয় উছাস নয়নকূলে।
তুমি যে ভুলেছ ভুলে গেছি, তাই এসেছি ভুলে॥
কাননের ফুল এরা তো ভোলে নি, আমরা ভুলি।
এই তো ফুটেছে পাতায় পাতায় কামিনীগুলি।
চাঁপা কোথা হতে এনেছে ধরিয়া অরুণকিরণ কোমল করিয়া,
বকুল ঝরিয়া মরিবারে চায় কাহার চুলে।
কেহ ভোলে কেউ ভোলে না যে, তাই এসেছি ভুলে॥
এমন করিয়া কেমনে কাটিবে মাধবীরাতি।
দখিনবাতাসে কেহ নাহি পাশে সাথের সাথি।
চারি দিক হতে বাঁশি শোনা যায়, সুখে আছে যারা তারা গান গায়–
আকুল বাতাসে, মদির সুবাসে, বিকচ ফুলে,
এখনো কি কেঁদে চাহিবে না কেউ আসিলে ভুলে।
কে উঠে ডাকি মম বক্ষোনীড়ে থাকি
কে উঠে ডাকি মম বক্ষোনীড়ে থাকি
করুণ মধুর অধীর তানে বিরহবিধুর পাখি॥
নিবিড় ছায়া গহন মায়া, পল্লবঘন নির্জন বন–
শান্ত পবনে কুঞ্জভবনে কে জাগে একাকী॥
যামিনী বিভোরা নিদ্রাঘনঘোরা–
ঘন তমালশাখা নিদ্রাঞ্জন-মাখা।
স্তিমিত তারা চেতনহারা, পাণ্ডু গগন তন্দ্রামগন
চন্দ্র শ্রান্ত দিকভ্রান্ত নিদ্রালস-আঁখি।
কে ডাকে আমি কভু ফিরে নাহি চাই
কে ডাকে। আমি কভু ফিরে নাহি চাই।
কত ফুল ফুটে উঠে, কত ফুল যায় টুটে,
আমি শুধু বহে চলে যাই॥
পরশ পুলকরস-ভরা রেখে যাই, নাহি দিই ধরা।
উড়ে আসে ফুলবাস, লতাপাতা ফেলে শ্বাস,
বনে বনে উঠে হা-হুতাশ–
চকিতে শুনিতে শুধু পাই। চ’লে যাই॥
কে দিল আবার আঘাত আমার দুয়ারে
কে দিল আবার আঘাত আমার দুয়ারে।
এ নিশীথকালে কে আসি দাঁড়ালে, খুঁজিতে আসিলে কাহারে॥
বহুকাল হল বসন্তদিন এসেছিল এক অতিথি নবীন,
আকুল জীবন করিল মগন অকূল পুলকপাথারে॥
আজি এ বরষা নিবিড়তিমির, ঝরোঝরো জল, জীর্ণ কুটীর–
বাদলের বায়ে প্রদীপ নিবায়ে জেগে বসে আছি একা রে।
অতিথি অজানা, তব গীতসুর লাগিতেছে কানে ভীষণমধুর–
ভাবিতেছি মনে যাব তব সনে অচেনা অসীম আঁধারে॥
কে বলে ‘যাও যাও’
কে বলে ‘যাও যাও’– আমার যাওয়া তো নয় যাওয়া।
টুটবে আগল বারে বারে তোমার দ্বারে,
লাগবে আমায় ফিরে ফিরে ফিরে-আসার হাওয়া ॥
ভাসাও আমায় ভাঁটার টানে অকূল-পানে,
আবার জোয়ার-জলে তীরের তলে ফিরে তরী বাওয়া ॥
পথিক আমি, পথেই বাসা–
আমার যেমন যাওয়া তেমনি আসা।
ভোরের আলোয় আমার তারা
হোক-না হারা,
আবার জ্বলবে সাঁজে আঁধার-মাঝে তারি নীরব চাওয়া ॥