ওহে সুন্দর মম গৃহে আজি পরমোৎসব-রাতি
ওহে সুন্দর, মম গৃহে আজি পরমোৎসব-রাতি
রেখেছি কনকমন্দিরে কমলাসন পাতি॥
তুমি এসো হৃদে এসো, হৃদিবল্লভ হৃদয়েশ,
মম অশ্রুনেত্রে কর’ বরিষন করুণ-হাস্যভাতি॥
তব কণ্ঠে দিব মালা, দিব চরণে ফুলডালা–
আমি সকল কুঞ্জকানন ফিরি এসেছি যূথী জাতি।
তব পদতললীনা আমি বাজাব স্বর্ণবীণা–
বরণ করিয়া লব তোমারে মম মানসসাথি॥
কখন দিলে পরায়ে স্বপনে বরণমালা
কখন দিলে পরায়ে স্বপনে বরণমালা,
ব্যথার মালা ॥
প্রভাতে দেখি জেগে অরুণ মেঘে
বিদায়বাঁশরি বাজে অশ্রু-গালা
গোপনে এসে গেলে, দেখি নাই আঁখি মেলে
আঁধারে দুঃখডোরে বাঁধিলে মোরে,
ভূষণ পরালে বিরহবেদন-ঢালা।
কখন যে বসন্ত গেল
কখন যে বসন্ত গেল, এবার হল না গান।
কখন বকুলমূল ছেয়েছিল ঝরা ফুল,
কখন যে ফুল-ফোটা হয়ে গেল অবসান॥
এবার বসন্তে কি রে যুঁথিগুলি জাগে নি রে–
অলিকুল গুঞ্জরিয়া করে নি কি মধুপান।
এবার কি সমীরণ জাগায় নি ফুলবন–
সাড়া দিয়ে গেল না তো, চলে গেল ম্রিয়মাণ॥
বসন্তের শেষ রাতে এসেছি যে শূন্য হাতে–
এবার গাঁথি নি মালা, কী তোমারে করি দান।
কাঁদিছে নীরব বাঁশি, অধরে মিলায় হাসি–
তোমার নয়নে ভাসে ছলোছলো অভিমান॥
কঠিন বেদনার তাপস দোঁহে
কঠিন বেদনার তাপস দোঁহে যাও চিরবিরহের সাধনায়।
ফিরো না, ফিরো না, ভুলো না মোহে।
গভীর বিষাদের শান্তি পাও হৃদয়ে,
জয়ী হও অন্তরবিদ্রোহে॥
যাক পিয়াসা, ঘুচুক দুরাশা, যাক মিলায়ে কামনাকুয়াশা।
স্বপ্ন-আবেশ-বিহীন পথে যাও বাঁধনহারা
তাপবিহীন মধুর স্মৃতি নীরবে ব’হে॥
কত কথা তারে ছিল বলিতে
কত কথা তারে ছিল বলিতে।
চোখে চোখে দেখা হল পথ চলিতে॥
বসে বসে দিবারাতি বিজনে সে কথা গাঁথি
কত যে পুরবীরাগে কত ললিতে॥
সে কথা ফুটিয়া উঠে কুসুমবনে,
সে কথা ব্যাপিয়া যায় নীল গগনে।
সে কথা লইয়া খেলি হৃদয়ে বাহিরে মেলি,
মনে মনে গাহি কার মন ছলিতে॥
কবে তুমি আসবে ব’লে রইব না বসে
কবে তুমি আসবে ব’লে রইব না বসে, আমি চলব বাহিরে।
শুকনো ফুলের পাতাগুলি পড়তেছে খসে, আর সময় নাহি রে॥
বাতাস দিল দোল্, দিল দোল্;
ও তুই ঘাটের বাঁধন খোল্, ও তুই খোল্।
মাঝ-নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে তরী বাহি রে॥
আজ শুক্লা একাদশী, হেরো নিদ্রাহারা শশী
ওই স্বপ্নপারাবারের খেয়া একলা চালায় বসি।
তোর পথ জানা নাই, নাইবা জানা নাই–
ও তোর নাই মানা নাই, মনের মানা নাই–
সবার সাথে চলবি রাতে সামনে চাহি রে॥
কাঁদার সময় অল্প ওরে ভোলার সময় বড়ো
কাঁদার সময় অল্প ওরে, ভোলার সময় বড়ো
যাবার দিনে শুকনো বকুল মিথ্যে করিস জড়ো ॥
আগমনীর নাচের তালে নতুন মুকুল নামল ডালে,
নিঠুর হাওয়ায় পুরানো ফুল ওই-যে পড়ো-পড়ো ॥
ছিন্নবাঁধন পান্থরা যায় ছায়ার পানে চলে,
কান্না তাদের রইল পড়ে শীর্ণ তৃণের কোলে।
জীর্ণ পাতা উড়িয়ে ফেলা খেল্, কবি, সেই শিশুর খেলা–
নতুন গানে কাঁচা সুরের প্রাণের বেদী গড়ো ॥
কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে
কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে–
নিবিড় বেদনাতে পুলক লাগে গায়ে॥
তোমার অভিসারে যাব অগম-পারে
চলিতে পথে পথে বাজুক ব্যথা পায়ে॥
পরানে বাজে বাঁশি, নয়নে বহে ধারা–
দুখের মাধুরীতে করিল দিশাহারা
সকলই নিবে-কেড়ে, দিবে না তবু ছেড়ে–
মন সরে না যেতে, ফেলিলে একি দায়ে॥
কাছে আছে দেখিতে না পাও
কাছে আছে দেখিতে না পাও,
তুমি কাহার সন্ধানে দূরে যাও।
মনের মতো কারে খুঁজে মরো,
সে কি আছে ভুবনে–
সে তো রয়েছে মনে।
ওগো, মনের মতো সেই তো হবে,
তুমি শুভক্ষণে যাহার পানে চাও।
তোমার আপনার যে জন, দেখিলে না তারে।
তুমি যাবে কার দ্বারে।
যারে চাবে তারে পাবে না,
যে মন তোমার আছে, যাবে তাও॥
কাছে থেকে দূর রচিল কেন গো আঁধারে
কাছে থেকে দূর রচিল কেন গো আঁধারে।
মিলনের মাঝে বিরহকারায় বাঁধা রে॥
সমুখে রয়েছে সুধাপারাবার, নাগাল না পায় তবু আঁখি তার–
কেমনে সরাব কুহেলিকার এই বাধা রে॥
আড়ালে আড়ালে শুনি শুধু তারি বাণী যে।
জানি তারে আমি, তবু তারে নাহি জানি যে।
শুধু বেদনায় অন্তরে পাই, অন্তরে পেয়ে বাহিরে হারাই–
আমার ভুবন রবে কি কেবলই আধা রে॥
কাছে যবে ছিল পাশে হল না যাওয়া
কাছে যবে ছিল পাশে হল না যাওয়া,
চলে যবে গেল তারি লাগিল হাওয়া ॥
যবে ঘাটে ছিল নেয়ে তারে দেখি নাই চেয়ে,
দূর হতে শুনি স্রোতে তরণী-বাওয়া ॥
যেখানে হল না খেলা সে খেলাঘরে
আজি নিশিদিন মন কেমন করে।
হারানো দিনের ভাষা স্বপ্নে আজি বাঁধে বাসা,
আজ শুধু আঁখিজলে পিছনে চাওয়া ॥
কার চোখের চাওয়ার হাওয়ায় দোলায় মন
কার চোখের চাওয়ার হাওয়ায় দোলায় মন,
তাই কেমন হয়ে আছিস সারাক্ষণ॥
হাসি যে তাই অশ্রুভরে নোওয়া,
ভাবনা যে তাই মৌন দিয়ে ছোঁওয়া,
ভাষায় যে তোর সুরের আবরণ॥
তোর পরানে কোন্ পরশমণির খেলা,
তাই হৃদ্গগনে সোনার মেঘের মেলা।
দিনের স্রোতে তাই তো পলকগুলি
ঢেউ খেলে যায় সোনার ঝলক তুলি,
কালোয় আলোয় কাঁপে আঁখির কোণ॥
কাল রাতের বেলা গান এল মোর মনে
কাল রাতের বেলা গান এল মোর মনে,
তখন তুমি ছিলে না মোর সনে॥
যে কথাটি বলব তোমায় ব’লে কাটল জীবন নীরব চোখের জলে
সেই কথাটি সুরের হোমানলে উঠল জ্বলে একটি আঁধার ক্ষণে–
তখন তুমি ছিলে না মোর সনে॥
ভেবেছিলেম আজকে সকাল হলে
সেই কথাটি তোমায় যাব বলে
ফুলের উদাস সুবাস বেড়ায় ঘুরে পাখির গানে আকাশ গেল পুরে,
সেই কথাটি লাগল না সেই সুরে যতই প্রয়াস করি পরানপণে–
যখন তুমি আছ আমার সনে॥