ওগো আমার চির-অচেনা পরদেশী
ওগো আমার চির-অচেনা পরদেশী,
ক্ষণতরে এসেছিলে নির্জন নিকুঞ্জ হতে কিসের আহ্বানে॥
যে কথা বলেছিলে ভাষা বুঝি নাই তার,
আভাস তারি হৃদয়ে বাজিছে সদা
যেন কাহার বাঁশির মনোমোহন সুরে॥
প্রভাতে একা বসে গেঁথেছিনু মালা,
ছিল পড়ে তৃণতলে অশোকবনে।
দিনশেষে ফিরে এসে পাই নি তারে,
তুমিও কোথা গেছ চলে–
বেলা গেল, হল না আর দেখা ॥
ওগো কাঙাল আমারে কাঙাল করেছ
ওগো কাঙাল, আমারে কাঙাল করেছ, আরো কী তোমার চাই।
ওগো ভিখারি আমার ভিখারি, চলেছ কী কাতর গান গাই’॥
প্রতিদিন প্রাতে নব নব ধনে তুষিব তোমারে সাধ ছিল মনে
ভিখারি আমার ভিখারি,
হায় পলকে সকলই সঁপেছি চরণে, আর তো কিছুই নাই॥
আমি আমার বুকের আঁচল ঘেরিয়া তোমারে পরানু বাস।
আমি আমার ভুবন শূন্য করেছি তোমার পুরাতে আশ।
হেরো মম প্রাণ মন যৌবন নব করপুটতলে পড়ে আছে তব–
ভিখারি আমার ভিখারি,
হায় আরো যদি চাও মোরে কিছু দাও, ফিরে আমি দিব তাই॥
ওগো তোমার চক্ষু দিয়ে মেলে সত্য দৃষ্টি
ওগো, তোমার চক্ষু দিয়ে মেলে সত্য দৃষ্টি
আমার সত্যরূপ প্রথম করেছ সৃষ্টি॥
তোমায় প্রণাম, তোমায় প্রণাম,
তোমায় প্রণাম শতবার॥
আমি তরুণ অরুণলেখা,
আমি বিমল জ্যোতির রেখা,
আমি নবীন শ্যামল মেঘে
প্রথম প্রসাদবৃষ্টি।
তোমায় প্রণাম, তোমায় প্রণাম,
তোমায় প্রণাম শতবার॥
ওগো পড়োশিনি শুনি বনপথে সুর মেলে
ওগো পড়োশিনি,
শুনি বনপথে সুর মেলে যায় তব কিঙ্কিণী॥
ক্লান্তকূজন দিনশেষে, আম্রশাখে,
আকাশে বাজে তব নীরব রিনিরিনি॥
এই নিকটে থাকা
অতিদূর আবরণে রয়েছে ঢাকা।
যেমন দূরে বাণী আপনহারা গানের সুর,
মাধুরীরহস্যমায়ায় চেনা তোমারে না চিনি॥
ওগো শান্ত পাষাণমুরতি সুন্দরী
ওগো, শান্ত পাষাণমুরতি সুন্দরী,
চঞ্চলেরে হৃদয়তলে লও বরি॥
কুঞ্জবনে এসো একা, নয়নে অশ্রু দিক্ দেখা–
অরুণরাগে হোক রঞ্জিত বিকশিত বেদনার মঞ্জরী॥
ওগো সখী দেখি দেখি মন কোথা আছে
ওগো সখী, দেখি দেখি, মন কোথা আছে।
কত কাতর হৃদয় ঘুরে ঘুরে, হেরো কারে যাচে।
কী মধু কী সুধা কী সৌরভ, কী রূপ রেখেছ লুকায়ে–
কোন্ প্রভাতে, ও কোন্ রবির আলোকে দিবে খুলিয়ে কাহার কাছে॥
সে যদি না আসে এ জীবনে, এ কাননে পথ না পায়!
যারা এসেছে তারা বসন্ত ফুরালে নিরাশপ্রাণে ফেরে পাছে॥
ওগো স্বপ্নস্বরূপিণী তব অভিসারের পথে পথে
ওগো স্বপ্নস্বরূপিণী, তব অভিসারের পথে পথে
স্মৃতির দীপ জ্বালা ॥
সেদিনেরই মাধবীবনে আজও তেমনি ফুল ফুটেছে
তেমনি গন্ধ ঢালা ॥
আজি তন্দ্রাবিহীন রাতে ঝিল্লিঝঙ্কারে স্পন্দিত পবনে
তব অঞ্চলের কম্পন সঞ্চারে।
আজি পরজে বাজে বাঁশি
যেন হৃদয়ে বহুদূরে আবেশবিহ্বল সুরে।
বিকচ মল্লিমাল্যে তোমারে স্মরিয়া রেখেছি ভরিয়া ডালা ॥
ওরে চিত্ররেখাডোরে বাঁধিল কে
ওরে চিত্ররেখাডোরে বাঁধিল কে– বহু- পূর্বস্মৃতিসম হেরি ওকে।
কার তুলিকা নিল মন্ত্রে জিনি এই মঞ্জুল রূপের নির্ঝরিণী– স্থির নির্ঝরিণী।
যেন ফাল্গুন-উপবনে শুক্লরাতে দোলপূর্ণিমাতে
এল ছন্দমুরতি কার নব-অশোকে॥
নৃত্যকলা যেন চিত্রে-লিখা
কোন্ স্বর্গের মোহিনী-মরীচিকা।
শরৎ-নীলাম্বরে তড়িৎলতা কোথা হারাইল চঞ্চলতা।
হে স্তব্ধবাণী, কারে দিবে আনি নন্দনমন্দারমাল্যখানি– বরমাল্যখানি
প্রিয়- বন্দনাগান-জাগানো রাতে
শুভ দর্শন দিবে তুমি কাহার চোখে?।
ওরে কী শুনেছিস ঘুমের ঘোরে
ওরে, কী শুনেছিস ঘুমের ঘোরে, তোর নয়ন এল জলে ভরে॥
এত দিনে তোমায় বুঝি আঁধার ঘরে পেল খুঁজি–
পথের বঁধু দুয়ার ভেঙে পথের পথিক করবে তোরে॥
তোর দুখের শিখায় জ্বাল্ রে প্রদীপ জ্বাল্ রে।
তোর সকল দিয়ে ভরিস পূজার থাল রে।
যেন জীবন মরণ একটি ধারায় তার চরণে আপনা হারায়,
সেই পরশে মোহের বাঁধন রূপ যেন পায় প্রেমের ডোরে॥
ওরে আমার হৃদয় আমার
ওরে আমার হৃদয় আমার, কখন তোরে প্রভাতকালে
দীপের মতো গানের স্রোতে কে ভাসালে ॥
যেন রে তুই হঠাৎ বেঁকে শুকনো ডাঙায় যাস নে ঠেকে,
জড়াস নে শৈবালের জালে ॥
তীর যে হোথা স্থির রয়েছে, ঘরের প্রদীপ সেই জ্বালালো–
অচল রহে তাহার আলো।
গানের প্রদীপ তুই যে গানে চলবি ছুটে অকূল-পানে
চপল ঢেউয়ের আকুল তালে ॥
ওরে জাগায়ো না ও যে বিরাম মাগে
ওরে জাগায়ো না, ও যে বিরাম মাগে নির্মম ভাগ্যের পায়ে।
ও যে সব চাওয়া দিতে চাহে অতলে জলাঞ্জলি॥
দুরাশার দুঃসহ ভার দিক নামায়ে,
যাক ভুলে অকিঞ্চন জীবনের বঞ্চনা ॥
আসুক নিবিড় নিদ্রা,
তামসী তুলিকায় অতীতের বিদ্রূপবাণী দিক মুছায়ে
স্মরণের পত্র হতে।
স্তব্ধ হোক বেদনগুঞ্জন
সুপ্ত বিহঙ্গের নীড়ের মতো–
আনো তমস্বিনী,
শ্রান্ত দুঃখের মৌনতিমিরে শান্তির দান॥
ওলো রেখে দে সখী রেখে দে
ওলো রেখে দে, সখী, রেখে দে, মিছে কথা ভালোবাসা।
সুখের বেদনা, সোহাগযাতনা, বুঝিতে পারি না ভাষা॥
ফুলের বাঁধন, সাধের কাঁদন, পরান সঁপিতে প্রাণের সাধন,
লহো লহো বলে পরে আরাধন– পরের চরণে আশা॥
তিলেক দরশ পরশ মাগিয়া, বরষ বরষ কাতরে জাগিয়া
পরের মুখের হাসির লাগিয়া অশ্রুসাগরে ভাসা–
জীবনের সুখ খুঁজিবারে গিয়া জীবনের সুখ নাশা॥
ওলো সই ওলো সই
ওলো সই, ওলো সই,
আমার ইচ্ছা করে তোদের মতন মনের কথা কই।
ছড়িয়ে দিয়ে পা দুখানি কোণে বসে কানাকানি,
কভু হেসে কভু কেঁদে চেয়ে বসে রই।
ওলো সই, ওলো সই,
তোদের আছে মনের কথা, আমার আছে কই।
আমি কী বলিব, কার কথা, কোন্ সুখ, কোন্ ব্যথা–
নাই কথা, তবু সাধ কত কথা কই॥
ওলো সই, ওলো সই,
তোদের এত কী বলিবার আছে ভেবে অবাক হই।
আমি একা বসি সন্ধ্যা হলে আপনি ভাসি নয়নজলে,
কারণ কেহ শুধাইলে নীরব হয়ে রই॥