এই সম্পর্ক গড়ে তুলতে না পারলে, অঙ্কের নিয়মে সবকিছু ঠিকঠাক থাকা সত্ত্বেও, বিপদ কীভাবে অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়, একটু বুঝিয়ে বললেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
ধরা যাক, আমরা চোদ্দো-মাত্রার অক্ষরবৃত্ত ছন্দে দু-লাইন কবিতা লিখতে চাই। তার বিষয়টা এই যে, উঁচুনিচু বৃক্ষ পথে হেঁটে-হেঁটে যাত্রীদের জীবন কেটে গেল। তা কথাটাকে যদি এইভাবে বলি :
অসমতল অমসৃণ পন্থায় হেঁটে
যাত্রীদের গিয়াছে সারা জীবন কেটে
তাহলে কি ঠিক হবে?
না, হবে না। অঙ্কের হিসেবে অবশ্য সবকিছু এখানে ঠিকঠাক আছে, ফিলাইনে চোদ্দো মাত্রার বরাদ্দ চাপাতে কোনও ত্রুটি ঘটেনি; তবু কান বলছে, ঠিক হল না। তার কারণ ঘোড়া দুটো এখানে দু-দিকে ছুটি লাগিয়েছে; ছন্দের চাল আর শব্দের উচ্চারণে বিরোধ ঘটছে পদে-পদে। ছন্দের চাল ঠিক রেখে এই লাইন দুটিকে যদি পড়তে যাই, তো এইভাবে পড়তে হয় :
অসমত/ল অমসৃ/ণ পন্থায়/হেঁটে
যাত্রীদের/গিয়েছে সা/রা জীবন/কেটে
অর্থাৎ, শব্দগুলিকে বেজায়গায় ভাঙতে হয়। কিন্তু শব্দকে তো আমরা তেমনভাবে ভাঙতে পারিনে। বলা বাহুল্য, ছন্দের খাতিরে শব্দকে অনেকসময়ে ভেঙে পড়তে হয়, কিন্তু সেই ভাঙারও একটা নিয়ম আছে, খেয়ালখুশিমতো যে-কোনও জায়গায় তাকে ভাঙা চলে না। শব্দ যদি ভাঙতেই হয়, তো নিয়ম মেনে এমনভাবে ভাঙতে হবে, যাতে কানের সমর্থন পাওয়া যায়। সুতরাং, হয় শব্দকে আদৌ না-ভেঙে লাইন দুটিকে আমরা এইভাবে লিখব :
অমসৃণ/অতিরুক্ষ/পথে-পথে/হেঁটে
যাত্রীদের/জীবনের/দিন গেল/কেটে
আর নয়তো ভাঙতে হলেও, কনের সমর্থন নিয়ে, এইরকমভাবে শব্দ ভাঙব :
বন্ধুর দা/রুণ রুক্ষ/পথে-পথে/হেঁটে
যাত্রী-জীব/নের দিন/রাত্রি গেল/কেটে
এই রকমে যদি শব্দ ভাঙি, তাহলে অক্ষরবৃত্তের ছোটো চালে (অর্থাৎ চার-মাত্রার চালে) যদি-বা ভাঙােটা চোখে পড়ে, বড়ো চালে (অর্থাৎ ৮+৬। মাত্রার চালে) সেটা আদৌ ধরা পড়ে না। ব্যাপারটা তখন এইরকম দাঁড়ায় :
বন্ধুর দারুণ বুক্ষ/পথে পথে হেঁটে
যাত্রী-জীবনের দিন/রাত্রি গেল কেটে
তাহলেই দেখা যাচ্ছে যে, ছন্দবিভ্ৰাট এড়াতে হলে লাইনে-লাইনে মাত্রার সংখ্যা ঠিক রাখাটাই যথেষ্ট নয়, শব্দগুলিকে সাজিয়ে বসাবার ব্যাপারেও নিয়ম রক্ষা করা চাই। নিয়মের সারকথাটা কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তই বলে গিয়েছেন। তার পরামর্শ: “বিজোড়ে বিজোড় গাঁথি, জোড়ে গাঁথি জোড়।” অর্থাৎ কিনা বিজোড়-শব্দের পিঠে বিজোড়-শব্দ বসাতে হবে, জোড়-শব্দের পিঠে। জোড়। শব্দের ব্যাপারে। জোড়-বিজোড় কাকে বলে, সেটা বুঝতে কারও অসুবিধে হবার কথা নয়। যে-শব্দের অক্ষরসংখ্যা বিজোড়, সেটা বিজোড়-শব্দ। যে-শব্দের অক্ষরসংখ্যা জোড়, সেটা জোড়-শব্দ। মোদ্দা কথাটা তাহলে এই দাঁড়াচ্ছে যে, দুই কিংবা চার অক্ষরের শব্দের পিঠে জোড়-শব্দ বসাতে হবে; এক কিংবা তিন অক্ষরের শব্দের পিঠে বিজোড়-শব্দ। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের চাল ঠিক রাখবার ব্যাপারে। এইটেই হচ্ছে সবচাইতে নিরাপদ নিয়ম।
*
এখন আমাদের আলোচনাকে একটু পিছিয়ে নিতে চাই। তার কারণ, অক্ষরে-অক্ষরে মিল ঘটিয়ে যুক্তাক্ষরের মায়া সৃষ্টি করে, অক্ষরবৃত্ত ছন্দে মাত্রা চুরি করা সম্পর্কে এর আগে যেসব কথা বলেছি, একটা জরুরি কথাই তাতে বাদ পড়ে। গিয়েছিল। আমার মাসতুতো ভাইয়ের সেই পদ্য-লিখিয়ে কনিষ্ঠ পুত্র সেটা মনে করিয়ে দিল। বুড়ো হয়েছি, সব কথা সর্বদা মনে থাকে না, চিন্তার শৃঙ্খলা নষ্ট হয়েছে, পরের কথাটা অনেকসময়ে আগেই বলে বসি, আগের কথার খেই হারিয়ে যায়, এগিয়ে গিয়েও মাঝে-মাঝে তাই পিছনে তাকাবার প্রয়োজন ঘটে। তাকিয়ে বুঝতে পারছি, জরুরি সেই কথাটা এবারে চুকিয়ে দেওয়া দরকার, নয়তো পরে আবার হয়তো ভুলে যাব।
কথাটা সংক্ষেপে এই :
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে ‘কলকাতা’ যে সহজেই ‘কল্কাতা’ (অর্থাৎ ৩ মাত্রা) হয়ে যায়, তা আমরা দেখেছি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, অক্ষরবৃত্তে কবিতা লিখতে গিয়ে ‘কলকাতা’কে আমরা ৪-মাত্রার শব্দ হিসেবে ব্যবহার করতে পারব না। আসলে, শব্দটাকে আমরা কীভাবে উচ্চারণ করব, তারই উপর নির্ভর করছে সে ক-মাত্রার মর্যাদা পাবে। গোটানো উচ্চারণে সে ৩-মাত্রার শব্দ বটে, কিন্তু ছড়ানো উচ্চারণে সহজেই সে আবার চার মাত্ৰা দাবি করতে পারে। নীচের লাইন দুটি লক্ষ করুন :
উচ্চারণভেবে হয় মাত্রাভেদ ভ্রাতা,
না হলে কলকাতা কেন হবে কলকাতা?
বুঝতেই পারছেন, দ্বিতীয় লাইনে ‘কলকাতা’ শব্দটিকে দু-বারে দু-রকমে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথম বারে সে গোটানো উচ্চারণে ৩-মাত্রা (কঙ্কাতা); দ্বিতীয় বারে সে ছড়ানো উচ্চারণে ৪-মাত্রা।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে, এইভাবে, উচ্চারণের তারতম্য অনুযায়ী, “খিদিরপুরীকে ৪মাত্ৰাও করা যায়, ৫-মাত্ৰাও করা যায়। ‘হ’ল’ক’কে ২-মাত্ৰাও করা যায়, ৩-মাত্ৰাও করা যায়। শরবতীকে করা যায়। কখনও ৩-মাত্রা কখনও ৪-মাত্রা। কয়েকটি লাইন দেখুন :
শহরের দক্ষিণেতে ‘খিদিরপুরে’তে
গিয়ে যদি খিদে পায়, কিছু হবে খেতে।
যদি দ্যাখো ‘খিদিরপুরে’ খাদ্যের দোকান
বন্ধ, তবে খেয়ে নিয়ো এক খিলি পান।
দ্বিপ্রহরে বাতাসের তপ্ত ‘হালকা’য়।
রাজপথে যদি বাছা মাথা ঘুরে যায়,
তদুপরি পেটে যদি ক্ষুধার ‘হলকা’-ও
চলে, তবে পান ছাড়া অন্য কিছু খাও।
কলেরার ভয় যদি না-ই থাকে প্রাণে,
‘শরবত’ খেতে পারো পানের দোকানে।
যদি নাড়ি ছাড়ে, তবু মনে রেখো প্রিয়,
ঘোলের শরবত অতি উত্তম পানীয়।