ভার তাহলে আরও বাড়িয়ে দেখি।
কৃষ্ণরাত্রি সাঙ্গ হয়ে আসে
রক্তচ্ছটা পূর্বের আকাশে।
কিন্তু তাতেও কিছু ইতারবিশেষ হল না। ফি-লাইনে তিন-তিনটে যুক্তাক্ষরকে অক্লেশে গিলে নিয়ে দশ-মাত্রার অক্ষরবৃত্ত সেই দশ মাত্রাতেই দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে।
দশ মাত্রায় যদি মন না। ওঠে তো চোদ্দো-মাত্রার লাইন নিয়ে পরীক্ষা করুন।
‘চলো ভাই মাঠে যাই বেড়াইয়া আসি’
বাল্যে-পাঠ্য একটি বিখ্যাত কবিতার এটি প্রথম লাইন। এর ছন্দ অক্ষরবৃত্ত। অক্ষরের সংখ্যা এখানে চোদ্দো, মাত্রার সংখ্যাও তা-ই। যুক্তাক্ষর এতে একটিও নেই। কিন্তু থাকলেও তার ফলে মাত্রার সংখ্যা বেড়ে যেত না। প্রমাণ দিচ্ছি :
চলো বন্ধু মাঠে যাই বেড়াইয়া আসি
ভাইকে তাড়িয়ে দিয়ে আমরা বন্ধুকে এনে ঘরে ঢোকালুম। ফলে একটি যুক্তাক্ষরও এল। কিন্তু মাত্রার সংখ্যা। তবু চোদ্দো-ই। এবার দেখুন :
চলো বন্ধু মুক্ত-মাঠে বেড়াইয়া আসি।
দু-দুটি যুক্তাক্ষর ঢুকেছে। কিন্তু মাত্রার সংখ্যা। তবু বাড়েনি। অতঃপর :
চলো বন্ধু সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে মাঠে যাই।
অর্থাৎ তিন-তিনটে যুক্তাক্ষর ঢুকল। কিন্তু মাত্রার সংখ্যা। তবু সেই চোদ্দেই, তার বেশি নয়। কিংবা :
সাঙ্গোপাঙ্গ সঙ্গে নিয়ে মুক্ত-মাঠে চলো
এবারে চার-চারটে যুক্তাক্ষর। কিন্ত লাইনের মাত্ৰাসংখ্যা। তবু সেই চোদ্দোতেই ঠেকে আছে, এক ক্ৰান্তিও বাড়েনি।
যুক্তাক্ষরের সংখ্যা এইভাবে আরও বাড়ানো যায়। কত যে বাড়ানো যায়, সেটা বোঝাতে গিয়ে রবীন্দ্ৰনাথ লিখেছিলেন :
‘দুৰ্দান্ত পণ্ডিত্যপূর্ণ দুঃসাধ্য সিদ্ধান্ত’
যুক্তাক্ষর এখানে গিসগিস করছে। কিন্তু মাত্রার সংখ্যা তবু সেই চোদ্দে তো চোদ্দেই, ওজনে-ভারী এতগুলি যুক্তাক্ষরকে বক্ষে ধারণ করেও অক্ষরবৃত্তের এই লাইনটি তবু সেই চোদ্দো-মাত্রাতেই ঠেকে আছে।
অক্ষরবৃত্ত যেন সৰ্বংসহা বসুন্ধরার মতো। তার উপরে যতই-না কেন ভার চাপানো হোক, মুখ বুজে। সে সহ্য করবে। তার জন্যে সে বাড়তি-মাত্রার মাশুল চাইবে না; যেমন অন্যান্য অক্ষরকে, তেমনি যুক্তাক্ষরকেও সে মাত্র এক-মাত্রার মূল্যেই বহন করে। তার দৃষ্টান্তও আমরা দিয়েছি।
কথা এই যে, দুটি অক্ষর যদি দৃশ্যত পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত না-হয়েও শ্রবণের বিচারে পরস্পরের সঙেগ জুড়ে যায়, তো অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কবিতায় সেই অক্ষরদুটিকে- দৃশ্যত তারা যুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও- মাত্র একমাত্রার মাশুল দিয়েই তারিয়ে দেওয়া যায় কি? যায় না, এমন কথা কেমন করে বলব? কবিরা অনেক ক্ষেত্রে দিব্যি তারিয়ে দেন। দৃষ্টান্ত দিচ্ছি :
চকর্পূর-সুবাসে জল ভরপুর হয়েছে
এই যে লাইনটি, এর মধ্যে ‘কর্পূর’ শব্দটি যে তিন-মাত্রা, তাতে সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, ‘ভরপুর’ও কি তা-ই?
হ্যাঁ, তা-ই। তার কারণ, ‘ভরপুর’-এর রিপু দৃশ্যত যুক্ত নয় বটে, কিন্তু শ্রবণের বিচারে যুক্ত। কান তাকে “ভপুর’ হিসেবেই গ্রহণ করেছে। এবং ছন্দবিচারে চোখ নয়, কানই যে হাকিম, তা কে না জানে!
অক্ষরের চাইতে ধ্বনি বড়ো। অক্ষর তো আর-কিছুই নয়, ধ্বনিরই একটা দৃশ্যরূপ মাত্র। আসলে যা ধর্তব্য, তা হচ্ছে ধ্বনি। তাই, চোখের নয়, কানের রায়ই শিরোধার্য। আর তাই, অক্ষরবৃত্তের লাইনে চার অক্ষরের শব্দ ‘কলকাতাকে অক্লেশে তিন-মাত্রা হিসেবে চালানো যায় (কেন-না। কান তাকে কল্কতা” বলে জানে), পাঁচ-অক্ষরের শব্দ “খিদিরপুর’কে চালানো যায় চার-মাত্রা হিসেবে (কেন-না কনের কাছে সে খিদিপুর), ছ-অক্ষরের শব্দ ‘কারমাইকেল’কে তারিয়ে দেওয়া যায় পাঁচ-মাত্রার মাশুল দিয়ে (কেন-না কর্ণে তিনি কাৰ্মাইকেল)। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের এই একটা মস্ত সুবিধে। যেখানে সম্ভব, শব্দকে সেখানে অক্ষরের তুলনায় কম-মাত্রার মাশুল দিয়ে তারানো যায়, ছন্দের ভারসাম্য তাতে নষ্ট হয় না। আবার তার দৃষ্টান্ত দিচ্ছি :
চারজন হাড়গিলে-ছোকরা ঘুরবার বাতিকে
কাতরাতে কাতরাতে চলল হাতিরাসের দিকে।
লক্ষ করে দেখুন, এই লাইন দুটির প্রত্যেকটিতেই অক্ষরের সংখ্যা আঠারো। কিন্ত তা সত্ত্বেও এরা চোদ্দো মাত্রার লাইন হিসেবে চলতে পারে। তার কারণ, চক্ষু এদের যে-চেহারাই দেখুক, কানের কাছে সংকুচিত হয়ে গিয়ে এরা এই রকমের চেহারা নেয় :
চার্জন হার্গিলে ছোক্ৰা ঘুর্বার বাতিকে
কাত্ৰাতে কাত্ৰাতে চল্লি হাত্ৰাসের দিকে।
আবার বলি, ছন্দের ব্যাপারে অক্ষর-বস্তুটা কিছু নয়, সে ধ্বনির-প্রতীক মাত্র, এবং ধ্বনিটাই হচ্ছে একমাত্র ধর্তব্য বিষয়। পরে তার আরও অজস্র প্রমাণ মিলবে।
বুদ্ধিমান পড়ুয়া আশা করি ইতিমধ্যেই একটা জরুরি কথা বুঝে নিয়েছেন। সেটা এই যে, অক্ষরবৃত্ত ছন্দ সংকোচনকে প্রশ্রয় দেয়, আর তাই হসন্ত অক্ষরমাত্রেই সেখানে পরবতী অক্ষরের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে তার আত্মস্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। বিশেষত, যুক্ত হবার বিধি যেখানে আছেই, সেখানে— দৃশ্যত আলাদা থাকলেও— শ্রবণের বিচারে যুক্ত হতে তাদের কিছুমাত্র আটকায় না। ল’য়ে ক’য়ে মিলন প্রথাসম্মত বলেই ‘কলকাতা’ আমাদের শ্রবণে ‘কল্কাতা’ হয়, ‘ত’য়ে ‘ত’য়ে মিলন রীতিসিদ্ধ বলেই ‘পাততাড়ি’ গুটিয়ে গিয়ে হয় ‘পাত্তাড়ি’।
কিন্তু মিলন যেখানে রীতিসিদ্ধ নয়, শ্রবণ কি সেখানেও অসবর্ণ বিবাহে অনুমোদন দেয়? তা-ও দেয়। এবং আমি যতদূর জানি, রবীন্দ্রনাথই সর্বপ্রথম, শ্রবণের অনুমোদন নিয়ে, সেই অসবর্ণ মিলন ঘটাতে সাহসী হয়েছিলেন। ‘আকবর বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই”- “বাঁশি” কবিতার এই লাইনটির সঙ্গে সকলেই পরিচিত। ছন্দ অক্ষরবৃত্ত। তার প্রশ্রয়ে ‘আকবর’ হয়েছে তিন-মাত্রা; বাদশার শব্দটিও তা-ই। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার এই যে, কয়ে ‘ব’য়ে মিলন রীতিবিরুদ্ধ নয় বটে, কিন্তু সেই ‘ব’-ফলায় ইংরেজি ‘বি’-অক্ষরের ধ্বনি আসে না (দৃষ্টান্ত; পকৃ, নিকৃণ), এক্ষেত্রে কিন্তু সেই ধ্বনিকে সম্পূর্ণ বঁচিয়েই কবি তাকে ‘কায়ের সঙ্গে জুড়েছেন। ‘বাদশা’র ব্যাপারটাও সমান চমকপ্ৰদ। ‘দ’য়ে শ’য়ে যুক্ত হবার রীতি নেই, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তবু অসম সাহসে তাদের মিলিয়ে দিয়েছেন।*