বাজে লক্ষ ঢাকঢোল
চতুর্দিকে হট্টগোল
আর সহ্য হয় কত,
প্ৰাণ হল ওষ্ঠাগত।
ভক্তেরা বিষম খান,
দলে-দলে মূৰ্ছা যান।
বুঝতেই পারছেন, কী হুলুস্থুলু ব্যাপার! বাড়তি দুমাত্রাকে ছোট দিয়ে শুধুই চারের চালের উপরে নির্ভর করে এই ছত্র-কটি দাঁড়িয়ে আছে। তার ফল হয়েছে এই যে, দাঁড়ি-কমা থাকা সত্ত্বেও লাইনের শেষে দাঁড়ানো যাচ্ছে না; ছন্দের তাড়না এতই প্রবল হয়ে উঠেছে যে, পাঠককে সে লাইন থেকে লাইনে ছুটিয়ে মারছে। এই ঘোড়দৌড়কে ঠেকাবার জন্যেই লাইনে-লাইনে বাড়তি দুটি মাত্রা জুড়ে দেওয়া দরকার।
কবিতার আলোচনায় ঘোড়দৌড় কথাটা যদি আপত্তিকর মনে হয়, তবে না-হয়। পাখির উপমা দেব। বাড়তি দু-মাত্রা যখন থাকে না, পাখিকে তখন ক্ৰমাগত উড়তে হয়। আর লাইনের শেষে ওই দু-মাত্ৰা আশ্রয় থাকলে সেইটোকে ধরে সে একটুক্ষণের জন্যে জিরিয়ে নিতে পারে। কিংবা বলি, চারের চালের কবিতা যেন একটা বহতা নদী। ফি-লাইনের শেষের ওই দু-মাত্রা তাতে বিয়ার মতন ভাসছে। সাতার কাটতে-কাটিতে আমরা ওই বয়াকে গিয়ে ধরছি– ব্যাপারটা অনেকটা এই রকমের।
মজা এই যে, লাইনটাকে যখন একসঙ্গে দেখি, তখন গোটা লাইনের বিন্যাসের মধ্যে ওই বাড়তি মাত্রা দুটি এমন চমৎকারভাবে নিজেদের ঢেকে রাখে যে, ওরা যে আলাদা, তা ঠিক ধরাও পড়ে না। বিশেষ করে, ছয় কি দশের বৃত্ত ছাড়িয়ে আমরা যখন চোদ্দো মাত্রায় গিয়ে পৌঁছেই, অতিরিক্ত ওই দু-মাত্রাকে তখন ছন্দের মূল চালেরই অঙ্গ বলে মনে হয়। তার হেতুটা আর কিছুই নয়, লাইনের টুকরো-টুকরো অংশের যেমন ছোটো মাপের চাল থাকে, তেমনি গোটা লাইনটারও আবার একটা বড়ো মাপের চাল থাকে। ছােটো মাপের চালের দিকে যখন তাকাই, বাড়তি দুমাত্রাকে তখন আলাদা করে দেখতে পাই; কিন্তু বড়ো মাপের চালের দিকে ৩াকালে আর দেখতে পাইনে। তার কারণ এই যে, ছোটো চালটা বাড়তি দু-মাত্রাকে দূরে ঠেলে দেয়; বড়ো চাল তাকে নিজের মধ্যে টেনে আনে। হাতেকলমে বুঝিয়ে দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে–
ওই শোনো সাড়ম্বরে প্রচণ্ড দাপটে
মহোল্লাসে লক্ষ লক্ষ ঢোল বেজে যায়।
এই-যে দুটি লাইন, ছোটো চালের হিসেব মেনে যদি এদের ভাগ করে ফেলি, ব্যাপারটা তাহলে এইরকম দাঁড়াবে–
ওই শোনো/সাড়ম্বরে/প্রচণ্ড দা/পটে
মহোল্লাসে/লক্ষ লক্ষ/ঢোল বেজে/যায়।
এইভাবে ভাগ করে দেখতে পাচ্ছি, ফি-লাইনের এক-এক অংশে (এই অংশেরই অন্য নাম ‘পর্ব) চারটি করে মাত্রা পড়ছে, আর লাইনের প্রান্তে পড়ে থাকছে সেই বাড়তি দু-মাত্রা।
কিন্তু কবিতা পড়বার সময়ে তো ঠিক এই রকমের ছোটো চালে পা ফেলে আমরা পড়িনে। আর-একটু লম্বা চালে এইরকমে পড়ি—
ওই শোনো সাড়ম্বরে/প্রচণ্ড দাপটে
মহোল্লাসে লক্ষ লক্ষ/ঢোল বেজে যায়।
তখন মনে হয়, লাইনগুলি যেন দুটি ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে আট মাত্রা, দ্বিতীয় ভাগে ছ-মাত্রা।
অক্ষরবৃত্তের আঠারো মাত্রার লাইনকেও এই বড়ো চালে ভাঙা যায়। ভাঙলে তার প্রথম ভাগে পড়বে আট মাত্রা, দ্বিতীয় ভাগে দশ মাত্রা।
মোটকথা, বড়ো চালে যখন চলি, লাইনের শেষের বাড়তি দু-মাত্রাকে তখন আর আলাদা করে ধরতে পারিনে। বাইরের লোক হয়েও সে তখন ছন্দের ভিতরে এসে ঢুকে পড়ে; বৈঠকখানায় দাঁড়িয়ে না থেকে অন্দরমহলে এসে আপনার লোক হয়ে যায়।
অক্ষরবৃত্তের চেহারা দেখলুম, চরিত্রের খোঁজখবর নিলুম, চালচলনেরও একটা আন্দাজ পাওয়া গেল। কিন্তু মোদী কথাটা বোঝা গেল কি?
আলোচনার সুবিধের জন্যে আবার চলুন ধ্বনিকে ছেড়ে অক্ষরের কাছে ফিরে যাই। আমি বলেছি, এ-ছন্দের এক-এক লাইনে অক্ষর যত, মাত্ৰাও তত। এইটেই সাধারণ নিয়ম। এর যে ব্যতিক্রম হয় না, তা নয়। বিস্তর হয়। তার কারণ, ধ্বনি সর্বদা অক্ষরের আঁচল ধরে চলে না। কিন্তু ব্যতিক্রমের কথা এখুনি বলতে চাইনে। পরে বলব। অক্ষরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও অনেকসময়ে ধ্বনির পরিসর কেন বাড়ে না, এবং মাত্রার যোগফলও তার দরুন। একটা নির্দিষ্ট হিসেবের মধ্যেই থেকে গিয়ে কীভাবে লাইনের ভারসাম্যকে ধরে রাখে, তা-ও বলব। আপাতত শুধু সাধারণ নিয়ম নিয়েই আলোচনা করা যাক।
সাধারণ নিয়মটা এই যে, অক্ষর আর মাত্রার সংখ্যা এতে সমান-সমান। তার চাইতেও জরুরি কথা, অক্ষর আর যুক্তাক্ষর এ-ছন্দে তুল্যমূল্য; অক্ষরবৃত্তের লাইনে যদি যুক্তাক্ষর-সংবলিত শব্দ ঠেসেও বসান, মাত্ৰা-সংখ্যার তবু ইতরবিশেষ হবে না। লাইনের ওজন তাতে বাড়বে বটে, কিন্তু দৈর্ঘ্য তার ফলে মাত্রার সীমা ছাড়াবে না। অর্থাৎ ছন্দও বে-লাইন হবে না।
দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। প্রথমে আসুন দশ-মাত্রার অক্ষরবৃত্ত নিয়ে পরীক্ষা করে দেখি।
নিশীথিনী ভোর হয়ে আসে
আলো ফোটে পুবের আকাশে।
দশ-মাত্রার অক্ষরবৃত্তে লেখা এই যে দুটি লাইন, এর মধ্যে যুক্তাক্ষর একটিও দেওয়া হয়নি। দিয়ে দেখা যাক কী হয়।
আমারাত্রি ভোর হয়ে আসে
আলো ফোটে পূর্বের আকাশে।
কী হল? কিছুই হল না। এক-এক লাইনে একটি করে যুক্তাক্ষর ঢোকালুম, কিন্ত অক্ষরবৃত্ত তাকে দিব্যি গিলে নিল। দশ-মাত্রা দশ-মাত্ৰাই আছে, এগারো হয়ে গিয়ে ছন্দপতন ঘটায়নি।
আরও কিছু ভার তাহলে চাপানো যাক :
অন্ধকার সাঙ্গ হয়ে আসে
রক্ত-আভা পূর্বের আকাশে।
এক-এক লাইনে এবারে দু-দুটো করে যুক্তাক্ষর বসালুম। কিন্তু তাতেই-বা কী হল? মাত্রা সেই দশেই আটকে আছে।