ব্যাপারটাকে এবারে হাতে-কলমে পরীক্ষা করে দেখা যাক। ‘গোলোক বৈকুণ্ঠপুরী সবার উপর’— এই লাইনটিকে একবার চেচিয়ে উচ্চারণ করুন তো। করেছেন? করতে যে-সময় লাগল, সেই উচ্চারণকাল মোট চোদ্দোটি মাত্রার সমষ্টি। অর্থাৎ এই মাত্রাগুলি হচ্ছে লাইনটির উচ্চারণকালের ক্ষুদ্রতম এক-একটি অংশ। মোট মাত্রা এখানে চোদ্দে! আবার লাইনটির মোট অক্ষরের সংখ্যাও তা-ই। কিন্তু অক্ষর আর মাত্রাকে এইভাবে তুল্যমূল্য করে দেখার একটা বিপদ আছে। যথা “ঐ দৃশ্যত একটিই অক্ষর বটে, কিন্তু তাকে ভেঙে “ওই লিখলেই অক্ষরের সংখ্যা দুয়ে গিয়ে দাঁড়ায়। অথচ “ঐ” আর ওইয়ের উচ্চারণ তো একই। ফলে, অক্ষরবৃত্তে কেউ যদি “ঐ” লিখে ওই একাক্ষর দিয়ে দু-মাত্রার কাজ চালান, তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। ‘বউ’ আর ‘বৌ’য়ের ক্ষেত্রেও সেই একই ব্যাপার। “হাওয়া’, “পাওয়া’, ‘খাওয়া”, ইত্যাদির বেলাতেও অক্ষর আর মাত্রাকে সংখ্যার ব্যাপারে। তুল্যমূল্য করে দেখবার উপায় নেই। ওসব শব্দের ‘ওয়া’-অংশে যদিও দুটি অক্ষর, কার্যত সেই অক্ষর দুটি কিন্তু এক মাত্রার বেশি দাম পায় না।]
তা ছাড়া আমরা চার-অক্ষরের সমবায়ে লিখি ‘তোমরই’ ‘আমারই’ কিন্তু উচ্চারণ করি ‘তোমারি’ ‘আমারি’; তিন অক্ষরের সমবায়ে লিখি ‘সবই’, কিন্তু উচ্চারণ করি ‘সবি’— ধ্বনির আয়তনের বিচারে দু-অক্ষরের ছবির সঙ্গে তার ফারাক থাকে না। পরে আমরা দেখিয়ে দেব যে, অক্ষর দেখে মাত্রা গুনতে গেলে আরও নানা বিপদ ঘটতে পারে। আপাতত এইটুকু জেনে রাখুন যে, ছন্দের ব্যাপারে। আসলে ধ্বনিটাই প্রধান কথা, অক্ষরটা নয়। তবু ছন্দশিক্ষার প্রাথমিক পর্বে (অর্থাৎ মাত্রা ইত্যাদির সঙ্গে পরিচয় ঘটেনি, তখন) অক্ষরের ভিত্তিতে ছন্দ চেনাবার চেষ্টা করেছি। এই জন্যে যে, নতুন পড়ুয়ার তাতে সুবিধে হয়। সেই প্রাথমিক পর্ব তো চুকেছে; এখন বলি, অক্ষরের উপর চোখ না-রেখে ধ্বনির দিকে কান রাখুন। ছন্দনির্ণয় আর মাত্ৰা-বিচার তাতেই নির্ভুল হবে।
এবারে তাহলে লাইনের দৈর্ঘ্যের হ্রাসবৃদ্ধির প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের নমুনা দিতে গিয়ে ইতিপূর্বে আমি যেসব লাইন তুল দিয়েছিলুম, তার প্রত্যেকটিই চোদ্দো মাত্রার লাইন। এবারে বলি, এ-ছন্দে ছ-মাত্রার লাইন লেখা যায়, দশ মাত্রার লাইন লেখা যায়, চোদো মাত্রার লাইন লেখা যায়, আঠারো মাত্রার লাইন লেখা যায়, বাইশ মাত্রার লাইন লেখা যায়, ছাব্বিশ মাত্রার লাইন লেখা যায়এমন কী, তিরিশ মাত্রার লাইনও আমি দেখেছি। তার বেশি বাড়াতে হলে চৌত্রিশ মাত্রায় যেতে হয়। কেউ গিয়েছেন বলে আমি জানিনে।
হ্রাসবৃদ্ধির কানুনটা তাহলে কী? এখনও সেটা বুঝতে পারেননি? ছয়, দশ, চোদ্দো, আঠারো, বাইশ— মাত্রার সংখ্যা কীভাবে বাড়ছে দেখুন। লোকে বলে চড় চড় করে বেড়ে যাওয়া, এখানে চারচার করে বাড়ছে। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের চাল আসলে চার মাত্রার চাল। মূলে রয়েছে চার। তার সঙ্গে, কিংবা চারের যে-কোেনও গুণিতকের সঙ্গে (অর্থাৎ চার-দুগুণে আটের সঙ্গে, কিংবা তিন-চারে বারোর সঙ্গে, কিংবা চার-চারে ষোলোর সঙ্গে, কিংবা চার-পাঁচে কুড়ির সঙ্গে) দুই যোগ করলে যে-সংখ্যাটা মিলবে, তত সংখ্যার মাত্ৰা দিয়েই অক্ষরবৃত্তের লাইন তৈরি করা যায়।
দৃষ্টান্ত দিচ্ছি :
লক্ষ ঢাকঢোল
বাজিছে হোথায়।
চক্ষু হয় গোল,
লোকে মূৰ্ছা যায়।
এ হল ৪+২=৬ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত। এত ছোটো মাপে যদি মন না ওঠে, তো এর সঙ্গে আরও চার মাত্রা জুড়ে দিয়ে ৪+৪+২=১০ মাত্রার লাইনও আমরা বানাতে পারি। ব্যাপারটা সেক্ষেত্রে এই রকমের দাঁড়াবে :
ওই শোনো প্ৰচণ্ড দাপটে
লক্ষ ঢাকঢোল বেজে যায়।
ভক্তের আসর জমে ওঠে
ঘন-ঘন-পতনে মূৰ্ছায়।
আরও বাড়াতে চান? বেশ তো বাড়ান না, ফি-লাইনে আরও চারটি করে মাত্রা জুড়ে দিন। দিলে হয়তো এই রকমের একটা চেহারা মিলতে পারে :
ওই শোনো সাড়ম্বরে প্রচণ্ড দাপটে
মহোল্লাসে লক্ষ লক্ষ ঢোল বেজে যায়।
গর্জনে-হুংকারে ওই সভা জমে ওঠে
ভক্তদের ঘন-ঘন পতনে মূর্ছায়।
এ হল ৪+৪+৪+২=১৪ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত।
ঠিক এইভাবেই আমরা আরও চারটি মাত্রা বাড়াতে পারি, এবং চোদ্দের জায়গায় আঠারো-মাত্রার (৪+৪+৪+৪+২-১৮) লাইন বানাতে পারি। কিন্ত তার আর দরকার কী?
কথা হচ্ছে, যে-ছন্দের চাল মূলত চার মাত্রার, তার ফি-লাইনে ওই বাড়তি দুমাত্রা যোগ করতে হয় কেন? বলি।
কবিতা পড়তে-পড়তে মাঝে-মাঝে একটু দম ফেলবার অবকাশ চাই। একটানা তো ছোটো যায় না; ছুটতে-ছুটিতে খানিক-খানিক দাঁড়িয়ে নেওয়া চাই। ওই দু-মাত্রা সেই ক্ষণিক-বিরতির ব্যবস্থা করেছে। ওদের যদি না জুড়ে দেওয়া হত, লাইনের শেষে তাহলে দাঁড়াবার জায়গা পাওয়া যেত না। প্রথম লাইন শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় লাইনের উপরে গিয়ে কুমড় খেয়ে পড়তে হত, দ্বিতীয় লাইন ফুরিয়ে যাবার সঙ্গে-সঙ্গেই তৃতীয় লাইনের উপরে। এবং এইরকমই চলত, গোটা কবিতাটা যতক্ষণ না একেবারে ফুরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তেমনভাবে তো আমরা কবিতা পড়তে পারিনে। পড়িমরি ছুটি লাগিয়ে কবিতা পড়া যায় না; আর-কিছু না হোক, দম ফেলবার ফুরসতটুকু চাই। সেই ফুরসতটুকুই মিলিয়ে দিচ্ছে ফি-লাইনের শেষে জুড়ে-দেওয়া ওই মাত্রা দুটি। ওরা যদি না-থাকত, কবিতা পড়া তাহলে যে কী ঘোড়দৌড়ের ব্যাপার হত, নীচের কয়েকটি লাইন পড়লেই তা বুঝতে পারবেন :