কিন্তু সেভাবে আপনি বলতে চান না; চান না যে, সিলেবল-এর বোঝাটা গোড়া থেকেই পাঠকের ঘাড়ে চাপুক। যুক্তাক্ষর বলেই যদি কাজ মিটে যায় তো ক্ষতি কী! ফলে আপনি তো দিব্যি টগবগিয়ে চলে গেলেন, কিন্তু ক্লাসে যারা ছন্দ পড়াবেন। তাদের কী দশা হবে?
কবিকঙ্কণের উত্তর
প্রতিভাজনেষু,
শঙ্খ, আপনার চিঠি পেয়ে বড়ো ভালো লাগল।
সত্যি, আমি ঠিকই করেছিলুম যে, সিলেবিক ছন্দ স্বরবৃত্তের এলাকায় ঢুকবার আগে সিলেবল-কথাটা মুখেও আনিব না। আমার ভয় ছিল, ছন্দের ক্লাসের যাঁরা প্রথম পড়ুয়া, গোড়াতেই যদি ‘মোরা’ সিলেবল ইত্যাদি সব জটিল তত্ত্ব তাঁদের বোঝাতে যাই, তাহলে তাঁরা পাততাড়ি গুটিয়ে চম্পট দেবেন। কিন্তু ‘অক্ষর’ সম্পর্কে সেই ভয় নেই। অক্ষর তারা চেনেন। তাই, প্ৰাথমিক পর্যায়ে, অক্ষরের সাহায্য নিয়ে আমি তাদের ছন্দ চেনাবার চেষ্টা করেছি। তবু, তখনও আমি ইতস্তত বলতে ভুলিনি যে, ধ্বনিটাই হচ্ছে প্রথম কথা; বলেছি যে, চোখ নয়, কানই বড়ো হাকিম। এমনকি, এ-ও আমি স্পষ্ট জানিয়েছি যে, অক্ষর আসলে ধ্বনির প্রতীক- মাত্র। ‘কবিতার ক্লাস’-এর পাণ্ডুলিপি তো আপনি দেখেছেন। অক্ষর ও ধ্বনি-বিষয়ক এসব মন্তব্য নিশ্চয় আপনার চোখ এড়ায়নি।
যুক্তাক্ষরের রহস্যটা আপনি ঠিকই ধরেছেন। এবং যেভাবে সেই রহস্যের আপনি মীমাংসা করেছেন, তাতে সমস্ত সংশয়ের নিরসন হওয়া উচিত। কিন্তু আপনি কি নিশ্চিত যে, ‘চৈত্র’কে চৈৎ + র’ হিসেবে বিশ্লিষ্ট করেই আপনি নিস্কৃতি পাবেন? বুদ্ধ সিলেবল চৈৎ কে আপনি দু-মাত্রার মূল্য দিচ্ছেন, মুক্ত সিলেবল রিকে দিচ্ছেন এক-মাত্রার। ফলত সব মিলিয়ে এই শব্দটি তিন-মাত্রার বেশি মূল্য পাচ্ছে না। আপনার এই হিসেবে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু কারও-কারও হয়তো আপত্তি থাকতে পারে। “মাত্রাবৃত্তে বুদ্ধিদল দু-মাত্রা পায়, মুক্তদল একমাত্ৰা”, এই বিধান মেনে নিয়েও তাঁরা প্রশ্ন তুলতে পারেন যে, চৈত্র’ কি বস্তৃত একটি বুদ্ধিদল ও একটি মুক্তদলের সমষ্টি? তারা দাবি করতে পারেন যে, চৈত্র’কে আসলে চ + ইৎ + ‘র হিসেবে বিশ্লিষ্ট করা উচিত, এবং সেই অনুযায়ী এই শব্দটিকে মোট চার-মাত্রার মূল্য দিতে হবে। (প্রথম ও শেষের দুটি মুক্তদলের জন্য দ-মাত্রা ও মধ্যবর্তী একটি বুদ্ধিদলের জন্য দু-মাত্রা।) সৈন্য’ দৈন্য ‘মৈত্রী’ ‘বৌদ্ধ’ ইত্যাদি শব্দের বেলাতেও আপনার হিসেবের বিরুদ্ধে এই একই রকমের দাবি উঠতে পারে। আপনি এদের সৈন্য + নি, দৈন্য + নি, মৈৎ + রী, বৌদ + ধ হিসেবে দেখাবেন। তাঁরা দেখাবেন স + ইন্ + ন, দ + ইন্ + ন, ম + ইৎ + রী, ব +উদ্ + ধ হিসেবে। আপনি এদের একভাবে বিশ্লিষ্ট করবেন; তারা করবেন আর-একভাবে।
আমি অবশ্য আপনার পন্থাতেই এসব শব্দকে বিশ্লিষ্ট করবার পক্ষপাতী। তার কারণ, আমি জানি যে, যুক্তস্বরের পরে হস্বৰ্ণ থাকলে (সেই হিসাবর্ণটি যুক্তাক্ষরের মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকলেও কিছু যায়-আসে না)। ধ্বনিসংকোচ আনিবাৰ্য হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ এ-তথ্য অনেক আগেই জেনেছিলেন। তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে, মাত্রাবৃত্তে ‘পৌষকে পুরো তিন-মাত্রার মূল্য দেওয়া চলে না; নইলে চিত্রা’ গ্রন্থের ‘সিন্ধুপারে কবিতায় (যা কিনা মাত্রাবৃত্তে লেখা) ‘পৌষ-শব্দটার চলতি বানান ছেড়ে তিনি “পউষ, প্রখর শীতে জর্জর..” লিখতে গেলেন কেন? উদ্দেশ্য যে পৌষ-এর উচ্চারণকে আর-একটু বিবৃত করে নিশ্চিন্ত চিত্তে ওকে তিন-মাত্রার পার্বণী ধরিয়ে দেওয়া, তাতে আমার সন্দেহ নেই।
বুঝতেই পারছেন, যুক্তাক্ষর-রহস্যের মীমাংসা যদি আমি সিলেবল ভেঙে করতে যৌতুম, তাহলে, প্রসঙ্গত, এসব প্রশ্ন উঠত। শব্দের বিশ্লেষণ-পদ্ধতি নিয়ে তর্ক বাধত। ধন্ধ দেখা দিত। ছন্দের প্রথম-পড়ুয়াকে সেই ধন্ধ থেকে আমি দূরে রাখতে চেয়েছি। যেভাবে বোঝালে তাঁরা চটপট ধরতে পারবেন, প্রাথমিক ব্যাপারগুলিকে সেইভাবেই তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি।
বাকিটা আপনারা বোঝান। আপনার ভাষায় দিব্যি টগবগিয়ে আমি চলে গেলুম। কিন্তু যাবার আগে, চৌরাস্তায় ড়ুগড়ুগি বাজিয়ে যেসব পড়ুয়া আমি জোগাড় করেছিলুম, আপনাদের ওই ক্লাসঘরের মধ্যেই তাদের আমি ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছি। এবারে আপনাদের পন্থায় আপনারা তাদের গড়েপিটে নিন। আমার পড়ুয়াদের আমি চিনি। তাই হলফ করে বলতে পারি, যে-পন্থাতেই পড়ান, তাদের নিয়ে বিন্দুমাত্র বেগ আপনাদের পেতে হবে না।