‘জিজ্ঞাসু পড়ুয়া’র চিঠি-২
সশ্রদ্ধ নিবেদন এই। যে শ্রদ্ধা নিয়ে আপনার কবিতার ক্লাসে আসন নিয়েছি, প্ৰত্যেক পাঠের পরে সে-শ্রদ্ধা ক্ৰমে বাড়ছে। গত রবিবারের পাঠ শুনে এবং আমার প্রশ্নের উত্তরে আপনার বক্তব্য জেনে আমার ছন্দবোধের কুয়াশা আরও অনেকখানি কেটে গেল। যাঁকে আমি ‘কবিঘাতক ছান্দসিক’ আখ্যা দিতেও কুষ্ঠাবোধ করিনি, আপনি সেই প্ৰবোধচন্দ্র সেনের প্রতি খুবই অনুকুল মনোভাব প্রকাশ করেছেন। চটে যেতাম, যদি আপনার সম্বন্ধে অটুট। শ্রদ্ধা না থাকত। তাই চটে না গিয়ে তঁর সম্বন্ধে আমার মনোভাবটা ঠিক কি না তা-ই যাচাই করে দেখতে হল। আপনার শেষ পাঠের সঙ্গে প্ৰবোধচন্দ্রের ‘ছন্দ পরিক্রমা’ বইটির মতামতটা মিলিয়ে দেখলাম। অক্ষরবৃত্ত ছন্দ সম্বন্ধে দুইজনের মতের মিল দেখে আমার বক্লোক্তিগুলির জন্য একটু কুষ্ঠাবোধই হল। এই বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে অক্ষরবৃত্তের আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি দিয়েছেন :
“পশমী শাল গায়ে দিয়ে
গেলাম কাশ্মীরে,
রেশমী জামা-গায়ে শেষে
আগরা এনু ফিরে।”
আপনার দৃষ্টান্তগুলির মিল দেখে অবাক হয়ে গেলাম। দুই জনের হিসাব দেবার রীতিতেও যথেষ্ট মিল। … কিন্তু একটা জায়গায় একটু খটকা লাগল। রবীন্দ্রনাথের ‘বাঁশি’ কবিতায় আছে :
“আকবর বাদশার সঙ্গে
হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই।”
এখানে ‘আকবর’ শব্দে। আপনি ধরেছেন তিন মাত্রা, ‘বাদশার’ শব্দেও তাই। ‘বাঁশি’ কবিতাটি পড়ে আমার মনে হল, ওই দুই শব্দে চার-চার মাত্ৰাই ধরা হয়েছে। কেন-না, ওই কবিতাটিতে টিকটিকি, ট্রামের খরচা, মাছের কানকা’, ‘আধমরা’ প্রভৃতি সব শব্দেরই মধ্যবর্তী হসবৰ্ণকে একমাত্রা বলে ধরা হয়েছে, কোথাও ব্যতিক্ৰম নেই। সুতরাং ‘আকবর’ ও ‘বাদশা’ শব্দের ক ও দ-কে একমাত্রা হিসেবে ধরা হবে। না কেন?
সবশেষে বলা উচিত যে, এই প্রশ্নের উদ্দেশ্য কবিতা-ক্লাসের সহায়তা করা, বাধা সৃষ্টি করা নয়। প্ৰবোধচন্দ্রও তীর ছন্দ-পরিক্রমা” বইটির নিবেদন অংশে জিজ্ঞাসু ছাত্রের প্রশ্নকে তাঁর চিন্তার সহায়ক বলেই স্বীকার করেছেন। তাই আশা করি আপনিও আমার প্রশ্নকে সেভাবেই গ্ৰহণ করবেন। ইতি ২০ আশ্বিন ১৩৭২।
অনুলেখ : আজকের পাঠের একটি দৃষ্টান্ত সম্বন্ধেও মনে একটা প্রশ্ন জেগেছে। সেটাও নিবেদন করি।–
‘কালকা মেলে টিকিট কেটে সে
কাল গিয়েছে পাহাড়ের দেশে।’
এটা অক্ষরবৃত্ত রীতিতে পড়তে গিয়ে যতটা কানের সায় পেয়েছি, তার চেয়ে বেশি সায় পেয়েছি স্বরবৃত্ত রীতিতে পড়ে। এরকম সংশয়স্থলে কী করা উচিত? ইতি ২৩ আশ্বিন ১৩৭২।
কবিকঙ্কণের উত্তর :
গত সপ্তাহের রবিবাসরীয় আলোচনীতে ‘জিজ্ঞাসু পড়ুয়া’র চিঠি পড়লুম।
(১) তাঁকে যে আমি প্ৰবোধচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করতে পেরেছি আপাতত এইটেই আমার মস্ত সাফল্য।
(২) ‘ছন্দ-পরিক্রমা’ আমি এখনও পড়িনি। পড়তে হবে। ছন্দ নিয়ে যখন আলোচনা করতে বসেছি, তখন প্ৰবোধচন্দ্রের সব কথাই আমার জানা চাই। শুনেছি প্ৰবোধচন্দ্ৰ এখন বাংলা কবিতার মূল ছন্দ তিনটির অন্য প্রকার নামের পক্ষপাতী। কেন, তা আমি জানিনে। জানতে হবে। ছিন্দ-পরিক্রমা” গ্রন্থে ব্যক্ত মতামতের সঙ্গে আমার ধারণার যদি বিরোধ না ঘটে, তবে সে তো আমার পক্ষে পরম শ্লাঘার বিষয়।
(৩) ‘বাঁশি’ কবিতার লাইন দুটির প্রসঙ্গে জানাই, স্মৃতি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমার স্মৃতিতে লাইন দুটির স্বাতন্ত্র্য বজায় ছিল না, তারা এক হয়ে গিয়েছিল, এবং সেইভাবেই, অর্থাৎ টানা লাইন হিসেবে, তাদের আমি উদ্ধৃত করেছিলাম। টানা লাইন হিসেবে গণ্য করলে দেখা যাবে, ‘আকবর’ ও ‘বাদশার’— এই দুই শব্দের কাউকেই তিন-মাত্রার বেশি মূল্য দেওয়া যায় না। দোষ আমার বিচারের নয়, অসতর্কতার।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ‘আকবর বাদশার সঙ্গে’- এই লাইনটিকে যদি পরবর্তী লাইনের সঙ্গে জুড়ে না-ও দিই, অর্থাৎ তাকে যদি আলাদাই রাখি, তবে তাতেই কি নিঃসংশয় হওয়া যায় যে, ‘আকবর’ ও ‘বাদশার’— এরা চার-মাত্রারই শব্দ? বলা বাহুল্য, পুরো লাইনটিকে দশ-মাত্রার মূল্য দিলে তবেই এরা চার-চার মাত্রার শব্দ হিসেবে গণ্য হবে। জিজ্ঞাসু পড়ুয়া সে-দিক থেকে ন্যায্য কথাই বলেছেন। কিন্তু পুরো লাইনটির মাত্ৰা-সংখ্যা যে দশের বদলে আটও হতে পারে, এমন কথা কি ভাবাই যায় না? যে-ধরনের বিন্যাসে এই কবিতাটি লেখা, সেই ধরনের বিন্যাসে রবীন্দ্ৰনাথ অনেক ক্ষেত্রে চার-মাত্রা কিংবা আট-মাত্রার লাইন রাখতেন। ‘বাঁশি’ কবিতাটিতেও আট-মাত্রার লাইন অনেক আছে।
মুশকিল এই যে, ‘আকবর বাদশার সঙ্গে’- এই লাইনও যে সেই গোত্রের, অর্থাৎ আট-মাত্রার, তা-ও আমি জোর করে বলতে পারছিনে। জিজ্ঞাসু পড়ুয়া এটিকে দশ-মাত্রার মূল্য দিয়েছেন : দিয়ে ‘আকবর’ এবং বাদশার’— এই শব্দ দুটিকে চার-চার মাত্রার শব্দ বলে গণ্য করেছেন। তিনি ভুল করেছেন, এমন কথা বলা আমার পক্ষে অসম্ভব। শুধু অনুরোধ জানাই, তিনিও একবার ভেবে দেখুন, পুরো লাইনটিকে আট-মাত্রার মূল্য দিয়ে, যদি কেউ ওই শব্দ দুটিকে তিন-তিন মাত্রার শব্দ হিসেবে গণ্য করে, তবে সেটা অন্যায় হবে কি না।
জিজ্ঞাসু পড়ুয়া অবশ্য তাঁর সিদ্ধান্তের সপক্ষে একটি জোরালো যুক্তি দিয়েছেন। সেটা এই যে, ওই কবিতাটিতে “সব শব্দেরই মধ্যবর্তী হস্বৰ্ণকে এক-মাত্রা বলে ধরা হয়েছে, কোথাও ব্যতিক্ৰম নেই।” সুতরাং ‘আকবর’ ও ‘বাদশার’ শব্দের মধ্যবর্তী ‘ক’ ও ‘দ’-কেও একটি করে মাত্রার মূল্য দেওয়া উচিত।