ছড়া বানানো বন্ধ করার আরও একটা কারণ ঘটেছে। অধ্যাপক মহাশয় একদিন ক্লাসে এসেই প্ৰবোধ সেনের আর-একখানি সদ্য-প্রকাশিত বই সকলের সামনে তুলে ধরলেন। তারপর চলল প্রশস্তি-বচন। আমি মনে মনে ভাবলাম৷- “এক রামে রক্ষা নাই, সুগ্ৰীব দোসর।”
বইটির নাম ছন্দ-পরিক্রমা। প্রথমে মনে হল, ছন্দ-পরিশ্রমা। অধ্যাপক মহাশয়ের নির্দেশে এই বইটাও নাড়াচাড়া করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে হল “ছন্দ-পণ্ডশ্রমা”। আমার মতো স্বভাবকবিকে ছন্দ বোঝাবার সমস্ত চেষ্টাই পণ্ডশ্রম, এ কথা স্বীকার করতে লজা নেই। বইটির প্রথমেই পরিভাষা, শেষেও তা-ই। পরিভাষার ইটপাটকেলে হোঁচটা খেতে-খেতে ক্ষতবিক্ষত হতে হয়। এগোনো আর হয় না। কোনও পরিভাষা কেন মানতে হবে বা কেন ছাড়তে হবে, তার যুক্তিজালে জড়িয়ে গিয়ে দিশেহারা হতে হয়। প্ৰবোধ সেনই একসময়ে ছন্দের তিন রীতির নাম দিয়েছিলেন- অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত। আর তিনিই বারবার নাম-বদল করে চলেছেন। এই বই পড়তে গিয়ে ডি.এল. রায়ের আর-একটা হাসির গান মনে পড়ে গেল :
“ছেড়ে দিলাম পথটা
বদলে গেল মতটা,
এমন অবস্থাতে পড়লে
সবারই মত বদলায়।”
এই মত-বদল নাম-বদলের পালা কবে শেষ হবে কে জানে। ততদিন ছন্দ শেখার ও ছন্দ লেখার কাজটা মুলতুবিই থাক না। তা ছাড়া যেটুকু সহজাত ছন্দবোধ আমার ছিল, এই বই পড়ে তা-ও ঘুলিয়ে গেল। সুতরাং ছড়া বানাবার অভ্যাস ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর উপায় কী?
এমন সময়ে কবিকঙ্কণের কবিতার ক্লাসে ঢুকে যেন দিব্যদৃষ্টি পেয়ে গেলাম। ছন্দতঙ্ক অ্যালার্জি কেটে গেল। উৎসাহিত হয়ে আগের সপ্তাহের রবিবাসরীয় আনন্দবাজার খুঁজে-পেতে বার করলাম। সে-সপ্তাহের কবিতার ক্লাসেও পাঠ নেওয়া গেল। দুই ক্লাসের পাঠ নিয়েই ছন্দবোধের কুয়াশা যেন অনেকটা কেটে গেল। আরও পাঠ নেবার জন্য মনটা উৎসুক হয়ে উঠেছে। আশা হয়েছে, পাঠ নেওয়া শেষ হলে ছন্দো-পাওয়া কবিবন্ধুকে একবার দেখে নিতে পারব। আর প্রবোধচন্দ্রের অন্ধভন্তু অধ্যাপক মহাশয়কেও…। না সে-কথা থাক। ইতিমধ্যে ভালো করে পাঠ নিয়ে রাখা দরকার। আর তা হাতে-কলমে হলেই ভালো। ভরসার কথা এই যে, অধ্যাপক সরখেল মহাশয়ের নাতি ও ভৃত্যটির ছড়া শুনে আমার সেই ছড়া বানাবার ছেড়ে-দেওয়া অভ্যাসটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এখন কবিতার ক্লাসের মনোযোগী ছাত্রের মতো পাঠ নিতেও পারব, প্রশ্ন করতেও পারব। প্রশ্নগুলি বোকার মতো না হলেই হল।
অধ্যাপক সরখেলের দৃষ্টান্ত নিয়েই নূতন ছড়া বানিয়ে প্রশ্ন করব :
স্বৰ্ণপাত্র নয় ওটা উধৰ্ব নীলাকাশে,
বিশ্বের আনন্দ নিয়ে পূৰ্ণচন্দ্ৰ হাসে।
এটা কোনরীতির ছন্দ? অক্ষরবৃত্তের? ভুল করিনি তো? এবার ছন্দের রীতিবদল করা যাক।
স্বৰ্ণপাত্র নয় সুনীল আকাশে,
পূর্ণিমা-চাঁদ হোথা সুখভরে হাসে।
এটা মাত্রাবৃত্ত তো? আমার কান তো তাই বলে। কর্ণধাররা কী বলেন, জানতে চাই। কানমলার ভয় যে একেবারেই নেই, তা বলতে পারি না। আবার রীতিবদল করা যাক :
সোনার থালা নয় গো ওটা
সুদূর নীলাকাশে,
বিশ্বপ্রাণে জাগিয়ে পুলক
পূৰ্ণিমা-চাঁদ হাসে।
এটাকে স্বরবৃত্ত ছন্দ বলা যায় কি? আমার কান তো তা-ই বলে। জ্ঞানের বিচারে কানের দণ্ডবিধান না হলেই বঁচি। জ্ঞানের এজলাসে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ালে প্ৰাণটাও ভয়ে কাঠ হয়ে যায়। হাকিমের রায় শূনে কানও অনেক সময়ে লাল হয়ে ওঠে। তবু অধ্যাপক সরিখেল মহাশয়ের পরীক্ষার হলে হাজির হয়েছি। যদি তার কাছে পাস-মার্কা পেয়ে যাই, তাহলে ছন্দো-পাওয়া কবি-বন্ধু ও প্রসেন-ভক্ত ছন্দঅধ্যাপককে…। না, এখনও সে-কথা বলবার সময় হয়নি। আগে তো কবিতার ক্লাসে রীতিমতো পাঠ নিতে হবে, প্রশ্নও করতে হবে সন্দেহ দূর করবার জন্য।
এবার মনের দুঃখে নিজের দুরবস্থার কথা ফলাও করে বলতে হল। ভবিষ্যতে সরখেল মহাশয়ের বিরক্তি ঘটাব না। সংক্ষেপেই প্রশ্ন করব।
কবিকঙ্কণের উত্তর
নাম যদিও জানা গেল না, তবু আমার বিন্দুমাত্ৰ সন্দেহ নেই যে, ‘জিজ্ঞাসু পড়ুয়া’ একজন পাকা ছান্দসিক। আমার ধারণা ছিল নেহাতই পাঠশালা খুলেছি, প্রথম পড়ুয়ারা যাতে ছন্দের ব্যাপারটাকে মোটামুটি ধরতে পারেন তার জন্যে সহজ করে। সব বুঝিয়ে বলব, জটিলতার পথে আদীে পা বাড়াব না। বাড়াবার সাধ্যও আমার নেই। একজন পাকা ছান্দসিক যে হঠাৎ সেই পাঠশালায় ঢুকে, পড়ুয়ার ছদ্মবেশে, পাটির উপরে বসে পড়বেন, এমন কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। তার পদার্পণে আমি কৃতাৰ্থ, কিন্তু ক্লাস নেবার কাজটা এবারে আরও কঠিন হয়ে উঠল।
‘জিজ্ঞাসু পড়ুয়া’ কিছু প্রশ্ন করেছেন। তাঁর প্রশ্নের উত্তর আমি এখুনি দিচ্ছিনে। ভাবছি, গোলমেলে কেস হাতে এলেই ছোটো ডাক্তাররা যেমন বড়ো ডাস্তারের সঙ্গে কনসালট করেন, তেমনিই আমাকেও হয়তো বড়ো ডাক্তারের শরণ নিতে হবে। এ-ব্যাপারে। আমি যাঁকে সেরা ডাক্তার বলে মানি, তিনি কলকাতায় থাকেন না। উত্তর পেতে তাই হয়তো দেরি হবে।
ইতিমধ্যে একটা কথা অকপটে নিবেদন করি। সেটা এই যে, ‘জিজ্ঞাসু পড়ুয়া’ যদিও আমরা দারুণ প্ৰশংসা করেছেন, তবু আমি খুশি হতে পারছিনে। খুশি হতে পারতুম, যদি তঁর চিঠিতে শ্ৰীপ্ৰবোধচন্দ্ৰ সেন সম্পর্কে কোনও বক্লোক্তি না থাকত।
কথাগুলি আমার জানা নেই। প্রথম কথাগুলি যদি জেনে থাকি, তবে শ্ৰীযুক্ত সেনের কাছ থেকেই জেনেছি। পরে আরও দু-এক জন প্রখ্যাত ছান্দসিকের কাছে পরোক্ষে পাঠা নিয়েছি ঠিকই, কিন্তু শ্রীযুক্ত সেনের কাছে আমার ঋণের পরিমাণ তাতে লাঘব হয় না। এই স্বীকৃতির প্রয়োজন ছিল। ‘জিজ্ঞাসু পড়ুয়া’ যদি এর ফলে আমার উপরেও চটে যান, তো আমি নিরুপায়।