যখন কলেজে পড়ি, তখন আবার এই একই অভিযোগ শোনা গেল জীবনানন্দের বিরুদ্ধে। কি না তাঁর ছন্দজ্ঞান বড়ো কম! অভিযোগের সমর্থনে তাঁর যে কবিতাটির সেদিন উল্লেখ করা হয়েছিল, সেটিতেও ছিল না পৌনঃপুনিক অন্ত্যমিলের আয়োজন; তবে প্রতিটি পঙক্তি সমান দৈর্ঘ্যের না হলেও এবং পঙক্তিশেষের ভাঙা-পর্বটি মাঝে-মাঝে বর্জিত হলেও (যা কিনা। রবীন্দ্রনাথও মাঝে-মাঝে অনাবশ্যক বিবেচনায় বর্জন করতেন) ছন্দ ছিল। অবশ্যই। সে-ও পরিপটি মিশ্রকলাবৃত্ত ছন্দ, বিষগ্নতা আর দীর্ঘনিশ্বাস-বিজড়িত বেদনার ভার যা বড়ো সহজে বহন করে। এবারে তবে কবিতাটির নাম বলা যাক। বিখ্যাত কবিতা। ধূসর পাণ্ডুলিপি-র ‘ক্যাম্পে’।
অভিযোগ কি বুদ্ধদেব বসুর বিরুদ্ধেই উঠত না? তা-ও উঠত বইকি। শুধুই যে তাঁর কবিতার বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণিত হত কিছু শুচিবায়ুগ্রস্ত মানুষের আপত্তির কোলাহল, তা নয়, বিস্তর পণ্ডিতস্মান্য ব্যক্তির মুখে তখন নিন্দামন্দ শোনা যেত তার ছন্দোজ্ঞানহীনতা’ সম্পর্কেও। এবং নিন্দামন্দ যে অকারণ নয়, তার প্রমাণ হিসেবে তাঁরা উল্লেখ করতেন বন্দীর বন্দনা-র অন্তর্ভুত এমন-সব কবিতার, যাতে ছন্দ ছিল আদ্যন্ত অতি পরিপটি ও সুশৃঙ্খল; না থাকবার মধ্যে শুধ ওই অন্তামিলটাই ছিল না।
চল্লিশের দশকে যাঁরা হরেক পত্রিকায় কবিতা লিখতে শুরু করেন, এক-আধ জনের কথা বাদ দিলে দেখা যাবে যে, আক্রমণের লক্ষ্য এক-কালে তারাও কিছু কম হননি। পরে গালাগাল খেয়েছেন তারাও, যাঁরা কিনা। “পঞ্চাশের কবি” হিসেবে আখ্যাত। এখন আবার গালমন্দ শুনতে হচ্ছে তাদের পরবর্তী কালের কবিদেরও। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেই একই একঘেয়ে অভিযোগ : ছন্দের ছাঁও এরা জানে না। সুতরাং কবিতা লেখার চেষ্টায় ক্ষান্তি দিয়ে এবারে “তফাত যাও…তফাত যাও”! এই যে অভিযোগ, এর উত্তরে আত্মপক্ষ সমর্থনের মতো হাস্যকর ব্যাপার। আর কিছুই হয় না। চল্লিশের সমর্থনে তাই অন্তত এই লেখকের পক্ষে একেবারে নীরব থাকাই ভালো। তবে পঞ্চাশের কবিরা যে ছন্দ-টন্দের ব্যাপারে একেবারে আকাট রকমের অজ্ঞ ছিলেন, এবং- সেই অজ্ঞতাকে কথার কম্বলে ঢেকেঢুকে রেখেস্রেফ নতুন রকমের উচ্চারণের জোরেই আবার মোড় ঘুরিয়েছিলেন বাংলা কবিতার, এইটে মেনে নেওয়া ভারী শক্ত। যদি বলি যে, তাদের পরে যাঁরা কবিতা লিখেছেন এবং এখনও লিখছেন, ছন্দজ্ঞান তাদেরও মোটামুটি টনটনে, তো মোটেই বাড়িয়ে বলা হবে না।
এরা ছন্দ জানেন না, এমন অভিযোগ তাহলে উঠছে কেন? উঠছে- যদ্দুর বুঝতে পারি— এই জন্য যে, অভিযোস্তাদের নিজেদেরই নেই ছন্দ বিষয়ে কোনও স্পষ্ট ধারণা। ছন্দ বলতে যে ঠিক কী বোঝায়, তা তাঁরা নিজেরাই জানেন না, যদিও তার জন্যে যে সমালোচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে র্তাদের কিছু আটকেছে, তা নয়। আটকায়নি। আসলে কোনও কালেই!
বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে আর-একটু খুলে বলি।
প্রান্তিক-এর প্রথম কবিতা পড়ে যিনি বলেছিলেন যে, ওতে ছন্দই নেই’, অনেক বছর পরে তাকে একদিন জিজ্ঞেস করি যে, ছন্দ তো ছিল, তাহলে কেন আমন কথা মনে হল তার। উত্তরে তিনি যে-যুক্তি দিলেন, তাতে তো আমি হতবাক। বন্দীর বন্দনা-র একাধিক কবিতার সূত্রে যাঁরা বলতেন যে, লেখকের ছন্দ-জ্ঞান বড়োই অল্প, তা একরকম “নেই বললেই চলে, একদা হতবাক হয়েছি তাদের কথা শূনেও। মনে-মনে ভেবেছি, ‘ও হরি, এই তাহলে ব্যাপার!”
এখন বিস্ময়বোধ অনেক কমে গিয়েছে। উদ্ভটসাগরদেরই তো এখন আধিপত্য, তাই এসব ব্যাপারে যিনি যতই উদ্ভট কথা বলুন, তাতে আর বিশেষ অবাক হই না। আর তা ছাড়া এই সহজ সত্যটা তো তখনই আমি জেনে গিয়েছি যে, অন্তমিলকেই অনেকে ছন্দ বলে মনে করেন। হালে আবার জানা গেল যে, তাদের সংখ্যাই দিনে দিনে বাড়ছে। পঙক্তি-শেষে চালাক-চালাক মিল থাকলে তবেই সেটা ছন্দ, নইলে নয়। ফলে, যে-কবিতায় অন্ত্যমিলের সাড়ম্বর আয়োজন নেই, তাতেও যে ছন্দ থাকতে পারে, থাকে, এই কথাটা তাদের কিছুতেই বোঝানো যাবে না। ”
তা-ও হয়তো যেত, যদি তারা ছন্দের ব্যাপারে একেবারে কিছুই না জানতেন। সেক্ষেত্রে তারা যে আর-একরকম জেনে বসে আছেন, এবং তারই জোরে জারি করছেন হরেকরকম ফতোয়া, সে-ই হয়েছে মস্ত বিপদ। এখন এই উলটো অ-আ-ক-খ’ তাদের কে ভোলাবে?
ভোলাবার দরকারটাই-বা কী। কিছু না-বুঝে কিংবা বেবাক ভুল বুঝে ছন্দ নিয়ে যাঁর যা খুশি বলুন না, তাতে কান না-দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।
এই পর্যন্ত পড়বার পরে অনেকের সন্দেহ হতে পারে যে, এই নিবন্ধের লেখক বোধ হয় অন্ত্যমিল নামক ব্যাপারটারই ঘোর বিরোধী। তা কিন্তু নয়। আসলে, রাইম বা অন্তমিল যে রিদম বা ছন্দের একটা জরুরি শর্ত, এই হাস্যকর কথাটাই সে বিশ্বাস করে না। কেন-না, তা যদি সে বিশ্বাস করত, তাহলে একইসঙ্গে তাকে এটাও বিশ্বাস করতে হত যে, গোটা সংস্কৃত কাব্যসাহিত্যের কোথাও কোনও ছন্দ নেই। না, ছন্দ আর মিল একেবারেই আলাদা দুটো ব্যাপার, পরস্পরের সঙ্গে কোনও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কসূত্রে তারা আবদ্ধ নয়। যা ছন্দোবদ্ধ, তাতে অন্তমিলের ব্যবস্থা অবশ্য থাকতেই পারে, কিন্তু সেটা যে থাকতেই হবে, এমন কোনও কথা নেই। ছন্দ আসলে অনেক বড়ো মাপের ব্যাপার। এতই বড়ো যে, দলবৃত্ত কলাবৃত্ত আর মিশ্রকলাবৃত্ত নামে যে-তিনটি বাংলা ছন্দের পরিচয় আমরা সকলেই রাখি, এবং মোটামুটি যার মধ্যেই দীর্ঘকাল যাবৎ আটকে ছিল বাংলা কবিতা, তার বলয়েও ছন্দ নামক ব্যাপারটাকে সর্বাংশে আঁটানো যাচ্ছে না। তার শরীরের অনেকটাই থেকে যাচ্ছে সেই বলয়ের বাইরে। ফলে, দলবৃত্ত কলাবৃত্ত আর মিশ্রকলাবৃত্ত ছন্দের (এবং তাদের ত্ৰিবিধ নিয়মেরই অন্তর্গত অসংখ্যরকম প্যাটার্ন বা বন্ধের) ধারও ধারছেন না যেসব কবি, এবং সেটা ধারবেন না বলেই এই তিন ছন্দের বলয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে লিখছেন তাদের কবিতা (যেমন ধরা যাক, সমর সেন তার সংক্ষিপ্ত কবি-জীবনের আদ্যন্ত লিখেছেন বা অরুণ মিত্র আজও লিখে যাচ্ছেন), তাঁদেরই বা আমরা কোন কানুনে ছন্দোজ্ঞানহীন বলব? কিংবা তাঁদের রচনাকে বলব ছন্দছুট?