পর্বশেষের লঘুযতি কীভাবে লোপ পায় আমরা তা দেখলুম। এতে ছন্দের কোনও হানি হয় না, বরং তার বিন্যাসে বেশ-একটা বৈচিত্র্যের ছোঁয়া লাগে।
পর্বান্তিক লঘুযতির মতো পদান্তিক অর্ধযতিও অনেকক্ষেত্রে লোপ পায়। কীভাবে পায়, আগের ওই উদারণটিকেই আরও-একটু ঘুরিয়ে সাজালে সেটা বোঝা যাবে। যেমন, ধরা যাক, আমরা যদি লিখি :
নতমুখে বলেছিলেন, হৃদয়ে রেখো আশা,
অন্ধকারে অন্নান জ্বলুক ভালোবাসা।
তাহলে এই পঙক্তি দুটির প্রথম পদ ও দ্বিতীয় পদের মধ্যবর্তী সীমারেখা স্পষ্ট হয়ে ফুটবে কি? ফুটবে না। পদ-বিভাজন সে-ক্ষেত্রে এই রকম হবে :
নতমুখে বলেছ, হু : দয়ে রাখো আশা,
অন্ধকারে অম্লান জ্ব : লুক ভালবাসা।
অর্থাৎ প্রথম পঙক্তির হৃদয়ে ও দ্বিতীয় পঙক্তির ‘জ্বলুক’ শব্দকে না ভেঙে আমরা একটানা উচ্চারণ করতে চাইব (কেন-না, সেটাই স্বাভাবিক উচ্চারণ), এবং তারই ফলে, প্রথম ও দ্বিতীয় পঙক্তির প্রথম পদের শেষে আমরা থেমে দাঁড়াতে পারব না। তখন আমরা বুঝে নেব যে পদান্তিক অর্ধর্ষতি এক্ষেত্রে লোপ পেয়ে গেল।
কিন্তু লঘুযতির বিলোপ যদিও পঙক্তি-বিন্যাসের কোনও ক্ষতি করে না, অর্ধার্যতির বিলোপ তাকে বেশ-খানিকটা ধাক্কা দেয়। কবিতার বিন্যাসে যারা আদ্যন্ত মসৃণতার পক্ষপাতী, তাদের পক্ষে তাই অর্ধার্যতিকে যথাসম্ভব বঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা করাই ভালো।
প্রসঙ্গত, একটা কথা বলি। লঘুযতি ও অর্ধার্যতি কীভাবে লোপ পায়, সেটা বোঝাবার জন্য আমরা এখানে যেসব উদাহরণের সাহায্য নিয়েছি, সেগুলি অক্ষরবৃত্তে লেখা। সেক্ষেত্রে মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্তে লেখা পঙক্তির সাহায্যেও যতিলোপের ব্যাপারটা অবশ্যই বুঝিয়ে বলা যেত। কিন্তু তার আর কোনও দরকার আছে কি? নেই নিশ্চয়?
কবিতার ক্লাসে তাহলে এখানেই আমি ছুটির ঘণ্টা বাজিয়ে দিলুম। এবারে পড়ুয়াদের মধ্যে উপাধিপত্র বিতরণের পালা। এই উপলক্ষে আমি পদ্যে একটি ভাষণ দিতে চাই।
১০. উপাধি-বিতরণ উপলক্ষে কবিকঙ্কণের ভাষণ
কবিতার ক্লাস অদ্য হৈল সমাপন,
কিছু উপদেশ দিব, শূন ছাত্ৰগণ।
বহুবিধ কৰ্ম আছে জগৎসংসারে,
তেমতি কর্মীও আছে হাজারে-হাজারে।
কেহ তেজারিতি করে, কেহ-বা মোক্তারি,
কেহ-বা দালালি করে, কেহ ঠিকাদারি।
কেহ-বা সাজায় যত্নে ইষ্টকের পাঁজা,
কেহ-বা পিষ্টক গড়ে, কেহ তেলেভাজা।
কেহ-বা পড়ায় ছাত্র, বিদ্যালয়ে যায়,
রাস্তার উপরে কেহ বান্দর নাচায়।
কেহ কৃষিকর্ম করে, কেহ ধান ভানে,
কেহ-বা চালায় টেমপে, কেহ রিকশা টানে।
পানের বোটাটি হস্তে, নাহি-ক সময়,
চলেছে দপ্তরে কেহ, ব্যস্ত অতিশয়।
কেহ-বা ডাক্তারি করে, বত্ৰিশ টাকার
ভিজিটে ছত্রিশ-তলা বাড়ি ওঠে তার।
কেহ করে রাজনীতি, অন্যের মাথায়
কৌশলে কঁঠাল ভেঙে মহানন্দে খায়।
কেহ তৈল বেচে, কেহ তেলা মস্তকের
উপরেই তৈল ঢেলে গুছায় আখের।
কেহ করে জনসেবা, ধন্য হয় দেশ;
কেহ-বা কাজের মধ্যে উলটায় গণেশ।
এইমতো নানা লোকে নানা কর্ম করে,
কর্মী নামে খ্যাত হয় বিশ্ব-চরাচরের
কর্মযোগী কৰ্মবীর নানা আখ্যা পায়,
কর্মের জাতাটি তারা অক্লেশে ঘুরায়।
তেমতি কবিতা লেখা কর্ম যদি হয়,
কবিকেও লোকে কমী বলিত নিশ্চয়।
কিন্তু যে কবিতা লেখে,- শিশু বৃদ্ধ নারী
সকলেই বলে তাকে ‘অকর্মর ধাড়ি’।
অশান্তিতে জ্বলে সদা কবির সংসার,
ভাই বন্ধু সকলেই নিন্দা করে তার।
“এইবারে ত্যাজ্যপুত্ৰ করিব ব্যাটাকে।”
জায়াও সর্বদা কয় মুখ করি কালো,
“ইহাপেক্ষা ডাকতের হাতে পড়া ভালো।”
বাড়িওলা শোনে যদি, নূতন ভাড়াটে
পদ্য লেখে, তবে তার ভয়ে দিন কাটে।
ইদানীং মুদিরাও হয়েছে সেয়ানা,
কবিকে বাকিতে তারা কিছুই দেয় না।
অধিক কবি কী, কোনো কাবুলিওলাও
কবিকে দেয় না কার্জ বলে, “ভাগ যাও।”
এইসব ভেবেচিন্তে ছাত্ৰগণ সবে
ঠিক করো, কবি কিংবা কৰ্মবীর হবে।
পিতার ধমক, মুদি যাবদের তাড়া,
বন্ধুদের ব্যঙ্গ, গৃহিণীর মুখনাড়া,
কোনোদিকে কিছুমাত্র দৃষ্টি নাহি হেনে,
সবকিছু ললাটস্য লিখনং’ জেনে
তবু পদ্য লিখিবার ইচ্ছা যদি হয়
মাঝে-মাঝে দুই ছত্র লিখিবা নিশ্চয়।
নিত্যও লিখিতে পারো, তবে কথা এই,
যত কবি বঙ্গে, তত পাঠক তো নেই।
আর যদি পাঠকের না করো পরোয়া,
তাহলে উত্তম কথা, সে তো বারো পোয়া।
সকালে লিখিয়ো তবে, দুপুরে লিখিয়ো,
বিকালে লিখিয়ো, শুধু রাত্রে ঘুম দিয়ে।
লিখিবার অন্ধিসন্ধি জেনেছ সবাই,
কবিতার ক্লাসে, তাই চিন্তা আর নাই।
শিখছ ছন্দের রীতি, বাক্যের কায়দা,
এইবারে তাহাতেই উঠিবে ফায়দা।
স্নাতক-উপাধি আমি দিলাম সকলে।
(জানি না কী ধুধুমার হবে তার ফলে।)
কবিকঙ্কণের কথা শেষ হৈল, আর
কথা নাই কিছু, যাও, সকলে এবার
তত পদ্য লেখো বাছা, যত ইচ্ছা হয়,
শুধু এক অনুরোধ, রাখিবা নিশ্চয়।
দৈনিক কাগজে পদ্য নাহি যায় ছাপা—
নিতান্ত সহজ কথা, মনে রেখে বাপা।
সুতরাং লেখো পদ্য হাজারে হাজারে,
কিন্তু তাহা পাঠিয়ো না ‘আনন্দবাজারে’।
সংযোজন ১ : গৈরিশ ছন্দ
গিরিশচন্দ্র যেসব নাটক লিখেছিলেন, তার সবই যে ছন্দোবদ্ধ, তা নয়। যেসমস্ত নাটক পৌরাণিক আখ্যানের ভিত্তিতে লেখা, কিংবা গোত্ৰবিচারে যা রোমান্টিক, শুধু তারই সংলাপকে তিনি ছন্দে বেঁধেছিলেন। আবার সেখানেও যে তার সমস্ত চরিত্রের সংলাপ একই ছন্দে বাঁধা, তা-ও নয়। একাধিক রকমের ছন্দের দোলা সেখানে আমরা দেখতে পাই। তার মধ্যে যেটা প্রধান ছন্দ, তাকেই আমরা ‘গৈরিশ ছন্দ’ বলে থাকি। একটা দৃষ্টান্ত দিচ্ছি :