নতমুখে/বলেছিলে/চিত্তে রেখো/আশা,
আঁধারেও/দীপ্তি যেন/পায় ভালো/বাসা।
সেক্ষেত্রে প্রতি পর্বের শেষে আমরা একটুক্ষণের জন্য থেমে দাঁড়াব, এবং এই যে একটুক্ষণের জন্য থেমে দাঁড়ানো, এটাই হচ্ছে লঘুযতি।।
বড়ো-পদক্ষেপে চললে কিন্তু পর্বে-পর্বে বিভক্ত না-হয়ে এই পঙক্তি দুটি আর একটু বড়ো-মাপে অর্থাৎ পদে-পদে ভাগ হয়ে যাবে। তখন ভাগটা হবে এইরকম :
নতমুখে বলেছিলে,/চিত্তে রেখো আশা,
আঁধারেও দীপ্তি যেন/পায় ভালোবাসা।
তখন দেখতে পাব যে, দুটি পঙক্তির প্রতিটির মধ্যেই রয়েছে দুটি করে পদ; অর্থাৎ এই পঙক্তি দুটি হচ্ছে দ্বিপদী পঙক্তি। (প্রথম পদ আর্ট-মাত্রার; দ্বিতীয় পদ ছ-মাত্রার) সেইসঙ্গে আর-একটা জিনিসও দেখা যাবে। সেটা এই যে, ছোটো-পদক্ষেপে চললে পর্বশেষে আমরা যেটুকু সময়ের জন্যে থেমে দাঁড়াচ্ছিলুম, বড়ো-পদক্ষেপে চলার ফলে পদশেষে তার চাইতে আর-একটু বেশি সময়ের জন্যে আমাদের থামতে হচ্ছে। আর দ্বিতীয় পদের সঙ্গে-সঙ্গে এক্ষেত্রে যেহেতু পঙক্তির সীমানাও শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাই সেখানে থামতে হচ্ছে আরও-একটু বেশি সময়ের জন্যে। পদশেষে আর পঙক্তি শেষে এই যে থেমে দাঁড়ানো, যথাক্রমে এরাই হচ্ছে অর্ধযাতি আর পূর্ণযতি।
অক্ষরবৃত্তের বদলে এবারে দ্বিপদী এই পঙক্তি দুটিকে আমরা মাত্রাবৃত্তে ঢালাই করব। যদি ৬-মাত্রার মাত্রাবৃত্তে ঢালাই করি, তাহলে এদের চেহারা দাঁড়াবে এইরকম :
নতমুখে তুমি বলেছিলে যেন চিত্তে খানিক আশা
জেগে থাকে। আর আঁধারেও যেন জ্বলে ওঠে ভালোবাসা।
এ-দুটিও দ্বিপদী পঙক্তি। পদে-পদে ভাগ করলে ব্যাপারটা এইরকম দাঁড়াবে :
নতমুখে তুমি বলেছিলে যেন / চিত্তে খানিক আশা
জেগে থাকে। আর আঁধারেও যেন / জ্বলে ওঠে ভালোবাসা।
পঙক্তি দুটিকে আমরা স্বরবৃত্তেও ঢালাই করতে পারি। লিখতে পারি :
শান্ত গলায় বলেছিলে, চিত্তে রাখো আশা
অন্ধকারের বুকে জ্বালাও গভীর ভালোবাসা।
এ-ও দ্বিপদী পঙক্তি। এর পদবিভক্তি হবে এইরকম :
শান্ত গলায় বলেছিলে / চিত্তে রাখো আশা,
অন্ধকারের বুকে জ্বালাও / গভীর ভালোবাসা।
এবারে ত্রিপদী পঙক্তির দৃষ্টান্ত দিই :
অবশ্যই তার চেয়ে আছে আরও ভাল মেয়ে, কিন্তু হে ঘটক,
আগে তারই কথা কও, অন্যথা বিদায় হও, সম্মুখে ফটক।
এর পদ-বিভাজন হবে এই রকম :
অবশ্যই তার চেয়ে / আছে আরও ভালো মেয়ে/কিন্তু হে ঘটক,
আগে তারই কথা কও,/অন্যথা বিদায় হও,/ সম্মুখে ফটক।
শব্দগুলিকে, ছন্দের চাল অনুযায়ী, এখানে দুই পঙক্তিতে সাজানো হয়েছে। আগেকার দিন হলে অবশ্য অন্য-বিন্যাসে এদের সাজানো হত। বিন্যাসটা হত এই-রকম :
অবশ্যই তার চেয়ে আছে আরও ভালো মেয়ে
কিন্তু হে ঘটক,
আগে তারই কথা কও, অন্যথা বিদায় হও,
সম্মুখে ফটক।
বলা বাহুল্য, ঘটক-মহাশয়ের প্রতি নিবেদিত এই শব্দাবলিকে এখানে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে ধরা হয়েছে। সেক্ষেত্রে, মাত্রাবৃত্ত কিংবা স্বরবৃত্তেও একে বিন্যস্ত করা যেত। কিন্তু আমরা তো এখানে ছন্দের পার্থক্য বুঝতে বসিনি, পদ-পরিচয়টাই শুধু পেতে চাইছি। আশা করি, সেই পরিচয় ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে।
এবারে একটু যতির কথায় ফিরব। যতির পরিচয় আমরা আগেই পেয়েছি। কিন্তু একটা জরুরি কথা তখন জানা হয়নি। সেটা এই যে, লঘুযতি ও অর্ধার্যতি মাঝে-মাঝে লোপ পেয়ে যায়। অর্থাৎ পর্ব কিংবা পদের শেষে তখন আর থেমে দাঁড়াবার উপায়। থাকে না। পুরোনো সেই উদাহরণটির উপরে আর-এক বার চোখ রাখা যাক :
নতমুখে বলেছিলেন, চিত্তে রেখো আশা,
আঁধারেও দীপ্তি যেন পায় ভালোবাসা।
পর্বের হিসেব করলে দেখা যাবে যে, অক্ষরবৃত্তে-লেখা এই পঙক্তি দুটির প্রতিটিতে আছে তিনটি করে পর্ব ও একটি করে ভাঙা-পর্ব। আবার, পদের হিসেব নিলে দেখতে পাব যে, এই পঙক্তি দুটির প্রতিটিতে আছে দুটি করে পদ। এখন কথা হচ্ছে, পর্ব ও পদের সীমানা এখানে এতই স্পষ্ট যে, পর্বশেষের লঘুযাতি ও পদশেষের অর্ধযতির ব্যাপারটাকে বুঝে নিতে এক্ষেত্রে আমাদের কিছু অসুবিধে হয়নি। কিন্তু আমরা যখন কবিতা লিখি, তখন পর্ব ও পদের সীমানা কি সর্বত্র এমন স্পষ্টভাবে টেনে দেওয়া যায়? যায় না। (পর্বের সীমানা তো মাঝে-মাঝেই অস্পষ্ট থেকে যায়।) কেন? কারণটা আর-কিছুই নয়, পর্ব অথবা পদের সঙ্গে শব্দের বিরোধ। পর্ব অথবা পদের সীমানা শেষ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও যখন শব্দের সীমানা শেষ হয় না, তখন অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় যে, (শব্দটাকে না ভেঙে) গোটা শব্দটাকে একসঙ্গে উচ্চারণ করবার প্রয়োজনে আমরা পর্ব অথবা পদের শেষে থেমে দাঁড়াতে পারছি না। আর তখনই আমরা বুঝতে পারি যে, লঘুযতি ও অর্ধর্যাতি এক্ষেত্রে লোপ পেয়ে গেল।
আগের উদাহরণের সামান্য-কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে এবারে নতুন করে সাজিয়ে নেওয়া যাক। লেখা যাক :
অস্ফুট বলেছ, যেন চিত্তে থাকে আশা,
আঁধারে অম্লান যেন জ্বলে ভালোবাসা।
বলা বাহুল্য, এইভাবে লিখলেও পঙক্তি দুটির ছন্দ একই থাকবে, কিন্তু দুটি পঙক্তির কোনওটিরই প্রথম পর্বের সীমানাকে এক্ষেত্রে আর স্পষ্ট করে দেখানো যাবে না। ফলে প্রথম পর্বের শেষে আর আমরা থেমে দাঁড়াতেও পারব না। পঙক্তি দুটির পর্ব বিভাজন এক্ষেত্রে এইরকম হবে 🙂
অস্ফুট ব : লেছ, যেন / চিত্তে থাকে / আশা,
আঁধারে অ : ম্লান যেন / জ্বলে ভালো / বাসা।