আসুন, আমরা নিজেরাই এবারে এই বন্ধে দু-লাইন লিখে ফেলি :
নিম্নে আদিগন্ত শুধু / সমুদ্র সুনীল
ঊর্ধ্বাকাশে উড়ে যায় / দুটি গাংচিল
এ হল পয়ারে-বাঁধা অক্ষরবৃত্তের নমুনা। তেমনি–
নীচে আদিগন্ত-যে / সিন্ধু সুনীল
ঊর্ধ্বে মেলেছে ডানা / দুটি গাংচিল
এ হল পয়ারে-বাঁধা মাত্রাবৃত্ত। ঠিক তেমনি—
যোজন-যোজন নীলের খেলা / সমুদ্দুরের জলে
ঊর্ধ্বাকাশে শুভ্র দুটি / সারস উড়ে চলে
এ হল পয়ারে-বাঁধা স্বরবৃত্তের দৃষ্টান্ত। (ছন্দ ঠিক রেখে চটপট ছাড়া বানাতে গিয়ে চিলকে সারস করে দিলুম, তার জন্যে চিলের কাছে তো বটেই, পড়ুয়াদের কাছেও ক্ষমা ভিক্ষা করি।) বলা বাহুল্য, যেহেতু ছন্দটা এখানে স্বরবৃত্ত, তাই সিলেবল-এর হিসেবে এখানে মাত্ৰাসংখ্যা ধরতে হবে।
পয়ার-বন্ধের কথা তো বলা গেল, এবারে খুব সংক্ষেপে মহাপয়ারের কথা বলা যাক। মহাপয়ারের নামেই প্রমাণ, ওটি আর-কিছু নয়, পয়ারেরই একটা বড় সংস্করণ। পয়ার যে-ক্ষেত্রে আট-ছায়ের বন্ধ, মহাপয়ার সে-ক্ষেত্রে আট-দশের। অর্থাৎ মহাপয়ারের বেলায় পঙক্তির প্রথমাংশে – পয়ারের মতোই- আট মাত্রা থাকে, কিন্তু দ্বিতীয়াংশ আরও বড়ো চালে দশ মাত্রায় ছড়িয়ে যায়। দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝানো যাক। পয়ারের বেলায় যে-দৃষ্টান্ত দিয়েছি, তারই বক্তব্যকে এখানে মহাপয়ারে বান্ধব।
নিম্নে সারাদিন দেখি / আদিগন্ত সমুদ্র সুনীল
ঊর্ধ্বে শ্বেতবিন্দুসম / উড়ে যায় দুটি গাংচিল।
এ হল মহাপয়ারে-বাঁধা অক্ষরবৃত্তের নমুনা। আবার—
নীচে আদিগন্ত-যে / চঞল সিন্ধু সুনীল ঊর্ধ্বে মেলেছে ডানা / সুন্দর দুটি গাংচিল এ হল মহাপয়ারে-বাঁধা মাত্রাবৃত্ত। আবার
যোজন-যোজন দেখছি শুধু / নীলের খেলা সমুদুরের জলে
ঊর্ধ্বকাশে পাল্লা দিয়ে / শুভ্র দুটি সারস উড়ে চলে।
এ হল মহাপয়ারে-বাঁধা স্বরবৃত্তের দৃষ্টান্ত। (হায় চিল, ছন্দের খাতিরে আবার তোমাকে সারস বানালুম!)
পয়ারি-মহাপয়ার প্রসঙ্গ এখানেই শেষ হল। এর পরে আসছে পদ, যতি ও যতিলোপের কথা।
০৯. পদ, যতি ও যতিলোপ
এবারে আমরা পদ-প্রসঙ্গে ঢুকব। পদ করে কয়? পিয়ার নিয়ে আলোচনার সময়ে তার কিছুটা আভাস দিয়েছিলুম। এবারে আর-একটু বিস্তারিতভাবে তার সুলুকসন্ধান নেওয়া দরকার।
সনেট তো চোদ্দো পঙক্তির কবিতা। বাংলায় তাকে আমরা চতুৰ্দশপদী কবিতা বলি। সেই বিচারে ‘পদ কথাটার অর্থ দাঁড়ায় পঙক্তি। শব্দকোশেও অন্যান্য অর্থের সঙ্গে, এই অর্থটা দেওয়া আছে বটে। কিন্তু এখানে আমরা ‘পদ” বলতে যা বোঝাতে চাইছি, তাতে এই অর্থটা পরিত্যাজ্য। কেন-না, একটু বাদেই আমরা দেখব যে, কবিতার পঙক্তিতে অনেকসময়ে একাধিক পদ থাকে। সেক্ষেত্রে, ‘পদ” বলতে যদি আমরা ‘পঙক্তি’ বুঝি, তাহলে ‘দ্বিপদী পঙক্তি’ কথাটার অর্থ দাঁড়াবে ‘দ্বি-পঙক্তিক পঙক্তি’, এবং ব্যাপারটা তখন খুবই ধোঁয়াটে হয়ে দাঁড়াবে।
তার চেয়ে বরং ‘পদ” বলতে ‘পদক্ষেপ” বোঝাই ভালো। বস্তৃত, প্রতি পদক্ষেপে যেখানে বিপদের আশঙ্কা কিংবা আনন্দের আশ্বাস রয়েছে, সেখানে তো আমরা ‘পদে-পদে বিপদ’ কিংবা ‘পদে-পদে আনন্দ”-এর কথাই বলে থাকি। (উদাহরণ : “নিবিড় ব্যথার সাথে পদে-পদে পরম সুন্দর”— রবীন্দ্রনাথ।)
এখন ব্যাপার হচ্ছে এই যে, কবিতার পঙক্তিগুলিকে তো আমরা একটানা পড়ে। যাই না, একটু লক্ষ করলেই দেখতে পাব, আমরা যখন কবিতা পড়ি, তখন সেই কবিতার এক-একটি পঙক্তি একাধিক অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। এটা হয় ছন্দের চালের জন্য। তা যেমন অক্ষরবৃত্ত ছন্দ, তেমনই পয়ার-বন্ধের আলোচনার সময়ে আমরা দু-রকম চালের কথা জেনেছিলুম। ছোটো-মাপের চাল আর বড়ো-মাপের চাল। চাল না-বলে একে চলন কিংবা পদক্ষেপও বলতে পারি। সত্যি, এ যেন দু-রকমের পদক্ষেপ। ছোটো-মাপের ও বড়ো-মাপের। এই দুই-মাপের পদক্ষেপ, আসলে, কবিতার পঙক্তির ভিতরকার দুই-মাপের দুটি অংশকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। আমরা যখন ছোটো পদক্ষেপে চলি, তখন ছোটো-মাপের অংশটাকে ধরতে পারি। আর বড়ো-পদক্ষেপে চললে সন্ধান পাই বড়ো-মাপের অংশের। ছোটো-মাপের অংশকে আমরা বলি। ‘পৰ্ব’’। বড়ো-মাপের অংশকে বলি “পদ”।
পদক্ষেপ-এর কথাটা যখন বলেইছি, তখন আর-একটু বিশদ করে বলা যাক। পদক্ষেপ করতে-করতে এগোনো মানে বারবার পা-ফেলা ও পা-তোলা। এই পাফেলা ও পা-তোলার মধ্যে একটু বিরতি ঘটে। এ যেন চলার মধ্যেই একটু থেমে থাকার ব্যাপার। আমরা যখন কবিতা পড়ি, তখন একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর, প্রায় আমাদের অগোচরে, এই থেমে-থাকার ব্যাপারটা ঘটতে থাকে। আমরা একটু চলি, একটু থামি, একটু চলি, একটু থামি— এই রকমের ব্যাপার। আর কী। কবিতায় এই থেমে-থাকার ব্যাপারটাকেই বলি ‘যতি’।
‘যতি’ আছে তিন রকমের। ছোটো যতি, মাঝারি যতি আর বড়ো যতি। ছান্দসিক এর নাম দিয়েছেন লঘুযাতি, অর্ধর্যাতি আর পূর্ণযতি। কবিতার পঙক্তির মধ্যে পর্ব যেহেতু সবচেয়ে ছোটো অংশ, তাই তার পরে আসে লঘুযতি; আর পদের মাপ যেহেতু পর্বের চেয়ে বড়ো, তাই তার পরে আসে অর্ধযতি।। পঙক্তির মাপ আরও বড়ো। তাই পূৰ্ণযতি আসে পঙক্তির শেষে।
একটা দৃষ্টান্ত দিই।
নতমুখে বলেছিলে, চিত্তে রেখো আশা
আঁধারেও দীপ্তি যেন পায় ভালোবাসা।
এই যে অক্ষরবৃত্ত-ছন্দ-লেখা দুটি পঙক্তি, ছোটো-পদক্ষেপে চললে— ছন্দের চাল অনুযায়ী— এরা পর্বে-পর্বে এইভাবে ভাগ হয়ে যাবে :